ডোমিনিকান রিপাবলিকে নিখোঁজ সুদিক্ষা কোনানকির সন্ধানে জোর তল্লাশি চলছে
ভারতে সোয়া ১ কোটি হিন্দু গো-মহিষের মাংস খায়
গো-রক্ষার নামে সমানে চলেছে গণপিটুনি ও হত্যাকাণ্ড৷ কিন্তু কেন এ সব ঘটনা বন্ধ করতে পারছে না সরকার? প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে এ প্রশ্ন ভারতের সুশিল সমাজের৷ ওদিকে গবাদি পশুর ব্যবসার ওপর নিষেধাজ্ঞা স্থগিত রেখেছে শীর্ষ আদালত৷
গো-রক্ষকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী মোদী এ পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি শব্দই খরচ করেছেন৷ গোমাংস বা গো-ব্যবসায়ীদের উপর হামলা মেনে নেওয়া যায় না৷ তবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুধু এ কথাই শুনতে চাওয়া হয়নি৷ জানতে চাওয়া হয়েছে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে? অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের উপর এই ধরনের হিংসা বন্ধ করতে তাঁর সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
এক এনজিও-র জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯৭ শতাংশ গণপিটুনি এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে মোদী ক্ষমতায় আসার পর৷ গোটা ভারতে কয়েক সপ্তাহের ঘটনার দিকে তাকালেই ছবিটা দিনের আলোর মতো ফুটে উঠবে৷ উত্তর প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ডে গোরক্ষার নামে চলেছে একের পর এক হামলা এবং মানুষ খুন৷ বিরোধীদের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী গো-রক্ষকদের বিরুদ্ধে কথা বললেও তাঁর সরকার প্রকারান্তরে গো-রক্ষক বাহিনীকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে৷ গত মাসে হরিয়ানার বল্লভগড়ের কাছে ট্রেনে জুনেইদ খান নামে ১৫ বছরের এক মুসলিম কিশোরকে হত্যা করা হয়৷ একদল দুষ্কৃতি গোমাংস খাওয়া এবং গোহত্যা নিয়ে তর্কের জেরে জুনেইদকে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে৷ ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকেই এই হত্যা বলে সন্দেহ৷ পুলিশ অবশ্য পরে হত্যাকারীকে মহারাষ্ট্র থেকে গ্রেপ্তার করে৷ কিন্তু এখানেই শেষ নয়৷ গত সপ্তাহেই দিল্লিতে লরিতে করে গরু নিয়ে যাওয়ার সময় সাতজন শ্রমিক গোরক্ষকদের হাতে গণপিটুনির শিকার হয়৷ কয়েকজনের আঘাত গুরুতর৷
গত ২৯শে জুন ঝাড়খণ্ডের রাঁচির কাছে আলিমুদ্দিন আনসারি নামে একজন গরু ব্যবসায়ী গণপিটুনিতে প্রাণ হারান৷ ঐ মাসেই এক ডেয়ারি মালিকের উপর শ-খানেক লোক চড়াও হয়৷ মারধর করে এবং তাঁর ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ কারণ? তাঁর ঘরের কাছে পড়েছিল একটা মরা গরু৷ পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরে গত ২৪শে জুন তিনজন নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে খুন করা হয়৷ অভিযোগ তাঁরা নাকি গরু চুরি করে পাচার করছিল৷ এপ্রিল মাসে আসামে আবু হানিফা এবং রিজাউদ্দিন আলি গণপিটুনিতে মারা যায়৷ সন্দেহ, তাঁরাও নাকি গরু চুরি ও পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল৷ পুলিশ অবশ্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করে৷
একই ধরনের ঘটনা ঘটে রাজস্থানের আলওয়ারে৷ ৫৫ বছর বয়সি পেহলু খানকে গরু পাচারকারী সন্দেহে এমনভাবে মারধর করা হয় যে, দু'দিন পর হাসপাতালে মারা যায় সে৷ হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন হত্যাকারীকে বাহাবা দিয়েছে বলে শোনা গেছে৷ মোদীর রাজ্য গুজরাটের উনা শহরের দিকে যাওয়ার রাস্তার পাশে এক দলিত পরিবারকে মরা গরুর চামড়া ছাড়াতে দেখে সেই ছবি কেউ পোস্ট করলে তা ভাইরাল হয়৷ গৌ-রক্ষকদের দল সেখানে পৌঁছে তাঁদের বেধড়ক পিটায়৷ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় দলিত সমাজে৷
২০১৭ সালের প্রথম ছ'মাসে গোরক্ষকদের হাতে প্রাণ হারায় ২২ জন৷ এই ঘটনা ক্রমশই বেড়ে চলেছে৷ থামার লক্ষণ নেই৷ দেশের সুশীল সমাজ অভিযোগের আঙুল তুলেছে মোদীর গৈরিক সরকারের দিকে৷ বলেছে, গোরক্ষার নামে হামলার পিছনে সরকারি প্রশ্রয় রয়েছে৷ অথচ সুপ্রিম কোর্ট হালে জবাইয়ের জন্য গরু-মোষ কেনাবেচা নিষিদ্ধ করার সরকারি নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন৷ দ্বিতীয়ত মোদী সরকারকে এটা বুঝতে হবে যে, গোমাংস ও চামড়ার ব্যবসা মুসলিম ও দলিত সম্প্রদায়ের পেশা বা জীবিকা৷ সেটা বন্ধ করা অযৌক্তিক৷ এর অভিঘাত দেশের অর্থনীতির উপরও পড়বে৷ এই নিয়ে মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীরা আওয়াজ তুললে সনাতন সংস্থা, বজরং দল, রাম সেনা, দুর্গা বাহিনী, হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির মতো হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনগুলি তাঁদের হত্যার হুমকি দেয়৷
এটাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে বিচার করলেন ইন্ডিয়ান ইন্সিটিটিউট অফ সোশ্যাল স্টাডিজের অধ্যাপক বুদ্ধদেব ঘোষ৷ ডয়চে ভেলে তিনি বললেন, “সন্দেহ নেই যে এর পিছনে সরকারের প্রশ্রয় আছে৷ তবে এ কথা ঠিক অনেক জায়গায় গরু জবাই করা হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে৷ তাই সেটার সংস্কার দরকার৷ কিন্তু মাংস খেতে দেবো না, বিক্রি করতে পারবে না – এটা কেমন কথা?”
বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ঘোষ মনে করেন, বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানও এক্ষেত্রে আলাদা৷ যেমন কুসংস্কার বা কুপ্রথা নিয়ে যখন কেউ কথা বলছেন, সেটা তিনি কুপ্রথা হিসেবেই বলছেন৷ সেটা গীতা বা মনুসংহিতায় লেখা আছে কিনা সেটা বড় কথা নয়৷ কিন্তু “মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মতে, কোরানে লেখা থাকলে সেটা কুপ্রথা বা কুসংস্কার হবে না৷ বরং না থাকলেই সেটা কুপ্রথা৷ এটাও ঠিক নয়৷ তাই প্রকাশ্যে এই নিয়ে বিতর্ক বা যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা দেওয়া হোক৷ ধর্মের সঙ্গে সবকিছু জড়িয়ে ফেললে চলে না৷” ডয়চে ভেলেকে তাঁর মনের কথা এভাবেই জানালেন অধ্যাপক বুদ্ধদেব ঘোষ৷
আরো কিছু তথ্য জানা থাকা দরকার-
অনেক হিন্দুও গরু বা মহিষের মাংস খায়:
গরু কম, মহিষ বেশি- হিন্দু প্রধান দেশ ভারতে ধর্মীয় কারণেই গরুর মাংস কম খাওয়া হয়৷ তবে মহিষের মাংস খায় অনেকেই৷ গরু এবং মহিষের মোট ভোক্তা প্রায় ৮ কোটি৷ ২০১১-১২-তে একটি জরিপ চালিয়েছিল ভারতের ‘দি ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস’(এনএসএসও)৷ সেই জরিপ থেকে বেরিয়ে এসেছে এই তথ্য৷
সাধারণ মানুষের মাঝে মাংস নিয়ে বিরোধ কোথায়?:
জরিপ থেকে আরো জানা গেছে, যাঁরা গরু বা মহিষের মাংস খায় তাঁদের বেশিরভাগই মুসলমান হলেও সেখানে সোয়া এক কোটি হিন্দুও এসব মাংস খেয়ে থাকে৷
সংখ্যাটা বাড়ছে:
জরিপ থেকে আরো জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশে গরু বা মহিষের মাংস খাওয়া বাড়ছে৷ এক কোটি মানুষের মধ্যে জরিপটি চালিয়েছিল এনএসএসও৷
মাংস খাওয়ায় ভারত সবার পিছনে:
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা(এফএও) ১৭৭টি দেশে সব ধরণের মাংস খাওয়ার হার সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ তালিকায় সবার নীচে রয়েছে ভারত৷
রপ্তানিতে সবার আগে:
এফএও-র তথ্য অনুযায়ী, গবাদি পশু- বিশেষ করে গরু এবং মহিষের মাংসের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ ভারত৷ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং নগরায়ণের কারণে মানুষের মাংস খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে৷ তারপরও অবশ্য অন্য সব দেশের তুলনায় ভারতের মানুষ এখনো অনেক কম মাংস খায়৷
হিন্দুরা দ্বিতীয়:
ভারতের মোট মুসলমানের মধ্যে প্রায় ৬ কোটি মুসলমান গরু বা মহিষের মাংস খায়৷ সংখ্যার দিক থেকে এর পরেই রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়। নিজেদের মোট সংখ্যার শতকরা হারের বিচারে মুসলমানদের পরেই রয়েছেন খ্রিষ্টানরা৷
যাঁরা বেশি খায়:
মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি নিম্ন বর্ণের হিন্দু এবং উপজাতিরাও যথেষ্ট গরু বা মহিষের মাংস খায়৷ উচ্চ বর্ণের অনেক হিন্দুও গরু বা মহিষের মাংস পছন্দ করে৷
এলএবাংলাটাইমস/আই/এলআরটি
শেয়ার করুন