যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যিক সম্পর্কে অনিশ্চয়তা
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কে অনিশ্চয়তা বাড়ছেই। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গ্রাফাইট রফতানিতে সীমা আরোপ করেছে বেইজিং। চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে নির্দিষ্ট কিছু গ্রাফাইট পণ্য রফতানিতে আলাদা অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে বলে জানিয়েছে দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে করে দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা ভূরাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা লাভ করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। খবর ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ গ্রাফাইটের ৬৭ শতাংশ সরবরাহ করে চীন। পাশাপাশি বিদ্যুচ্চালিত গাড়িতে (ইভি) প্রয়োজনীয় গ্রাফাইটের ৯০ শতাংশের বেশি সরবরাহ করে দেশটি। ইভির ব্যাটারি তৈরির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গ্রাফাইট। সেমিকন্ডাক্টর, রাসায়নিক ও ইস্পাত শিল্পেও এর ব্যবহার রয়েছে।
চীনের সিদ্ধান্তটিকে এর আগে ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। গত সপ্তাহে প্রযুক্তি রফতানিতে সীমা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে জাতীয় নিরাপত্তাকে কারণ দেখিয়ে চীনের ৪২ কোম্পানিকে রফতানি নিয়ন্ত্রণ তালিকায় যুক্ত করে ওয়াশিংটন। কোম্পানিগুলো রাশিয়ার কাছে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট ও মিসাইল গাইডেন্স সিস্টেম সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। চীনের সেমিকন্ডাক্টর ব্যবসায় প্রথম সারিতে রয়েছে আলিবাবা ও বাইদুর নাম। তারা পুরনো ও মজুদকৃত চিপের ওপর নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্রের সীমা আরোপের নীতিতে তাদের ওপর সেভাবে পড়বে না বলে মনে করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ব্রডকমের ৬ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের চুক্তি ঠেকিয়ে দিতে পারে চীনা নীতিনির্ধারকরা। সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ভিএমওয়্যারকে অধিগ্রহণ করতে চাইলেও কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা এলে সেটি ব্রডকমের জন্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে। এর আগে ২০১৭ সালে ব্রডকম ১৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে কোয়ালকম অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছিল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য তা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান উরসুলা ভন ডের লিয়েনের মধ্যে আলোচনা চলমান। সেখানে শুল্ক আরোপের পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আমদানি করা স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর থেকে শুল্ক স্থায়ীভাবে অপসারণ করতে চায়। সেক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও চীনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিশ্বের দুটি বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যকার উত্তেজনা বাড়তে থাকায় ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে তাইওয়ান, টিকটক ও সেমিকন্ডাক্টর পর্যন্ত নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অবস্থান ভিন্ন মেরুতে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে ব্যবসা সরিয়ে নিচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় ভূরাজনৈতিক টানাপড়েন ও সম্পর্কের অনিশ্চয়তাকে তারা সরবরাহ চেইনের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে।গ্রাফাইট রফতানিতে সীমা আরোপের আগে চিপ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় আরো কিছু পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল বেইজিং। গত ১ আগস্ট গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় তারা। এতে করে রফতানি কমে যাওয়ায় বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে।
পিটারসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনের আমদানির ৫৮ দশমিক ৩ শতাংশ আমদানি শুল্কের অধীন রয়েছে। উভয় পক্ষই এটি হ্রাস করবে এমন কোনো লক্ষণ নেই। বৈশ্বিক বাণিজ্যে চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার অবনতি ঘটাতে পারে। মার্কিন চাপের কারণে চীনা টেলিকম কোম্পানি হুয়াওয়ের কার্যক্রম অনেক দেশে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ায় এমনিতেই ক্ষুব্ধ চীন। তাইওয়ানকে কেন্দ্র করেও বাড়ছে ভূরাজনৈতিক টানাপড়েন। বিকল্প সরবরাহ চেইন তৈরির ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি মাথায় রেখেছে বেইজিং। বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের অধীনে তৈরি করছে পৃথক বলয়। এখন নতুন করে গ্রাফাইট রফতানিতে সীমা আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলমান প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ককে আরো জটিল রূপ দেবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন