ইসরাইলি কারাগারে ফিলিস্তিনি নারীদের নানা দুঃসহ যাতনার চিত্র
নারী অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ফিলিস্তিনেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জাতিসংঘের মতে এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার’।
সমতার জন্য নারীদের আন্দোলন ও সংগ্রামকে উদযাপন করতে প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
ফিলিস্তিনে ইসরাইলি কারাগারে বন্দি নারীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন ‘নাদীল আসীর’। দিবসটি উপলক্ষে সংগঠনটি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে উঠে আসে ইসরাইলি কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনি নারীদের নানা দুঃসহ-যাতনার চিত্র।
প্রতিবেদন অনুযায়ী ইসরাইল ১৯৬৭ সাল থেকে ১৬ হাজার ফিলিস্তিনি নারীকে গ্রেফতার করে এবং গ্রেফতার পরবর্তীতে কারাগারের অভ্যন্তরে ও তদন্ত কার্যক্রম চলাকালীন তাদেরকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়।
সংগঠনটির পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, এখনও ইসরাইলি কারাগারে ৪৩ নারী বন্দি রয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৬ জন রয়েছেন যারা স্তন্যদান করেন।
২৭ জনের ব্যাপারে আদালতের রায় প্রকাশিত হয়েছে। যাদের বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে কারও কারও শাস্তি ১৬ বছর দীর্ঘায়িত হয়েছে।
সংগঠনটির বক্তব্য অনুযায়ী প্রথম ফিলিস্তিনি নারী যিনি দখলদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি ছিলেন জেরুজালেম শহরের ফাতেমা বার্নাভি। ১৯৬৭ সালে গ্রেফতার হয়ে ১৯৭৭ সালে মুক্তি পেয়েছিলেন।
ইসরাইলি কারাগারে ফিলিস্তিনি নারীদের দুঃসহ দিনযাপন
ফিলিস্তিনি নারীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন আর মৌলিক অধিকার হরণ দখলদার অবৈধ রাষ্ট্রটির নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলেও মানসিক নির্যাতনের কাহিনী থেকে যাচ্ছে একেবারেই অজানা।
এর মধ্যে দিনভর না খাইয়ে রাখার মতো অমানবিক-নির্মম ঘটনাও ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। প্রতিবাদে কারাবন্দিদের নিজ দেহ ক্ষতবিক্ষত করার ঘটনাও ঘটছে। আদালতে আনা-নেয়ার সময় কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা তাদের ভাগ্যে কোনো খাবার জোটে না। খাবারের নামে সামান্য যেটুকু সরবরাহ করা হয়, তা ক্ষুধা নিবারণ হওয়ার মতো নয়।
ফ্রান্সিস মিডল ইস্ট আইকে বলেন, তদন্তকারী অফিসাররা চিৎকার চেচামেচি করতে থাকে। তাদের ভীতসন্ত্রস্ত করার চেষ্টা করে। এমন কিছু প্রশ্ন করে যা তাদের অনুভূতিকে নাড়া দেয়। যেমন, তুমি বিয়ের পর তোমার স্বামীর সঙ্গে কী করেছ? ইত্যাদি ইত্যাদি।
যদিও ইসরাইলি আইনে নারীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একজন নারী অফিসার দেয়ার কথা রয়েছে, তবে তারা বন্দিদের বেলায় এসব নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করে না। বরং তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করার জন্য বিভিন্ন বাহানা খুঁজতে থাকে।
শিরিন ঈসায়ী একজন প্রসিদ্ধ আইনজীবী। তিনি ৫ বছর কারাভোগ করেছেন। তার মধ্যে ৪ বছর কারা ভোগ করেছেন, বন্দিদের জন্য অর্থ সরবরাহের দায়ে।
তিনি বলেন, অধিকাংশ অফিসাররাই আমাদের সঙ্গে যৌনতার ভাষায় কথা বলতেন। তিনি ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে ছাড়া পান।
তারা বলেন, নারী কয়েদিদের কোর্টে হাজিরা এবং এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে আসা-যাওয়ার সময় অনেক সময় প্রায় ১২ ঘন্টা টানা গাড়িতে থাকা লাগত। এই দীর্ঘ সময় আমাদের সঙ্গে কোনো নারী পুলিশ থাকত না। পুরুষ আমাদের সঙ্গে বিশ্রী ভাষায় কথা বলত।
খিতাম সাআফিন ফিলিস্তিনি নারীদের একটি সংগঠনের সদস্য। তিনি বলেন, অধিকাংশ সময় ইসরাইলি সৈন্যরা যুবতীদের টার্গেট করে থাকে এবং তাদের সফরে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে থাকে। কারাগারে যৌন-নিপীড়ন, গুরুতর রোগের শিকার হন অধিকাংশ নারী কয়েদি।
তবে গুরুতর থেকে লঘু অপরাধের অভিযোগে বন্দি এসব নারীদের ওপর যৌন নিগ্রহসহ নানা নিপীড়ন চালানোর অভিযোগ রয়েছে। নাবালিকা কয়েদিরা প্রায় সময়েই যৌন নিগ্রহের শিকার হন। আর এসব ঘটনার অনেকগুলোর সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
ইসরাইলি কারাগারে নারী কয়েদিরা পুরুষ কয়েদিদের তুলনায় বেশি অসুস্থ হন। হেপাটাইটিস সি, এইচআইভি, বিভিন্ন চর্মরোগ নিয়ে জর্জরিত থাকেন তারা। সবসময়ে এর যথাযথ চিকিৎসাও পান না নারীরা।
কারাগারে থাকাকালীন অনেক অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে গর্ভবতীও হয়ে পড়েন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ বিষয়েও নিরুত্তাপ থাকে। ইসরাইলি কারারক্ষীদের উপর্যুপরি দুর্ব্যবহারের শিকার হয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেক নারী কয়েদি।
এদিকে কারাগার থেকে বের হওয়ার পরে চাকরি পাওয়া বা স্কুল-কলেজে যাওয়া একরকম অসম্ভব হয়ে যায় নারীদের। এসব বিবরণ দিযেছেন খিতাম সাআফিন।
খিতাম সাআফিন তিন মাস কারাভোগ করেছেন। তার ব্যাপারে কোনো অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। ইসরাইলি সৈন্যরা তাকে তদন্তের নামে উলঙ্গ করে বিভিন্ন যৌন ভঙ্গিতে ছবি তোলে। কিছু কিছু ফিলিস্তিনি নারী যদিও তাদের ধর্ষণের শিকার হওয়ার ব্যাপারে কথা বলেন, তবে অধিকাংশেই এ ব্যাপারে সমাজের ভয় নিশ্চুপ থাকেন।
তাছাড়া কারাগারে তাদের ওপর যে যৌন নিপীড়ন তার উপযুক্ত প্রমাণ না থাকার কারণে তারা বিষয়টি নিয়ে আদালতেও বিচার চাইতে পারেন না।
বিশেষত গর্ভবর্তী নারীদের বাচ্চা প্রসবের বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় এক ভয়াবহ ব্যাপার। সন্তান প্রসব হওয়ার সময় কাছাকাছি হলে তারা সেই নারীটিকে একটি পিলারের সঙ্গে বেঁধে ফেলে। তার কাছে একজন মহিলা পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তাকে নড়াচড়ারও কোনো সুযোগ দেয়া হয় না। কোনো শব্দ করারও অধিকার নেই। শব্দ করলেই শুরু হয় নিপীড়ন কিল-ঘুষি-লাথি।
খাওলা ফাতাহ নারী বিপ্লবী পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। তাকে মোট চারবার গ্রেফতার করা হয়। তিনি সর্বপ্রথম গ্রেফতার হন যখন তার বয়স ১৪ বছর। তার বিরুদ্ধে যখন তিন বছর জেলের সাজা আসে তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন।
সাহর ফ্রান্সিস ফিলিস্তিনি বন্দিদের অধিকার বিষয়ে কাজ করেন। তিনিও গ্রেফতার হন ইসরাইলি হায়েনাদের হাতে। কারাগারের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, গ্রেফতারের পর থেকেই নানা রকম নিপীড়ন শুরু হয়।
যে নারীরা হিজাব পড়েন তারা গ্রেফতারের পর সৈনিকদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় লিপ্ত হন, যাতে তাদেরকে হিজাব পড়ার অনুমতি দেয়া হয়। তদন্তের নামে তাদের ওপর চলে নির্যাতনের স্টিম রোলার। তাদেরকে টানা নির্ঘুম রাখা হয়। পেটাতে পেটাতে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। দিনের পর দিন কোনো খাবার সরবরাহ করা হতো না।
খাওলা আযরাক। এখন ৪৫ বছরের এক নারী। ইতিপূর্বে কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছিলেন ইসরাইলি হায়েনাদের হাতে। কারাগারে তার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়-তুফানের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি।
সর্বপ্রথম ১৪ বছর বয়সে গ্রেফতার হন ইসরাইলিদের হাতে। কয়েক যুগ পার হয়ে গেলেও আজও সে নিপীড়নের কথা বলতে গিয়ে তিনি কম্পিত হয়ে পড়েন।
সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার এখনও মনে আছে, একজন অফিসার তার চেয়ারটি আমার কাছে এনে আমার দিকে পা প্রসারিত করে বসলেন। তিনি বিভিন্নভাবে বুঝাতে চাইলেন, তিনি আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইছেন।
ওই লোকটি বারবার আমার কাধে হাত রেখে আমাকে ভীতসন্ত্রস্ত করার চেষ্টা করছিলেন, যাতে আমি তার যৌন লালসা পূরণের সময় বাধা না দিই। অফিসাররা তদন্তের নামে আমাদের শরীরের স্পর্শকাতর জায়গাগুলো স্পর্শ করত। বসার সময় আমাদের খুব কাছে এসে বসত, যাতে আমাদের শরীরের উত্তাপ তারা অনুভব করতে পারে।
শেয়ার করুন