আর্কাডিয়ায় বাড়িতে অনুপ্রবেশকারীর গুলিতে ৬১ বছর বয়সী পিতার মৃত্যু; সন্দেহভাজন পলাতক
বেক্সিমকো গ্রুপের জন্য ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা
বেক্সিমকো গ্রুপের নানা অনিয়মের ঋণসহ মোট পাঁচ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার ঋণ ২০২৬ সাল পর্যন্ত পুনঃ তফসিল করে দেওয়া হচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের পর জনতা ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ পুনঃ তফসিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অগ্রণী, রূপালী, ন্যাশনাল, এক্সিম, এবি ব্যাংকেও চলছে এই প্রক্রিয়া।বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী তিনবারের বেশি কোনো খেলাপি ঋন পুনঃ তফসিল করা যায় না। অথচ সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ এরই মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ সপ্তমবারের মেতা পুনঃ–তফসিল করেছে। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের আবেদন গ্রহণ করে ঋণ পুনঃ তফসিল করা হচ্ছে। সালমান এফ রহমান আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা। আর্থিক খাতে নানা অনিয়মের দায়ে বেক্সিমকো গ্রুপ তিন দশকের বেশি সময় ধরেই আলোচনার কেন্দ্রে। এর আগেও বারবার পুনঃ তফসিল করে ঋণ পরিশোধ করেনি গ্রুপটি। আবার ১৯৯৬ ও ২০০৯-১০ সালে শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় বেক্সিমকো গ্রুপের নাম রয়েছে।সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ গত নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বেক্সিমকোর ৯৮২ কোটি ৪৪ লাখ টাকার ঋণ সপ্তমবারের মতো পুনঃ তফসিলের সিদ্ধান্ত নেয়। ঋণ পরিশোধের সময় দেওয়া হয়েছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময়ের জন্য অন্য কাউকেই এই সুবিধা দেওয়া হয়নি। আর জনতা ব্যাংকের পর্ষদ গত বুধবার এক হাজার ৮৫৩ কোটি টাকার ঋণ পুনঃ তফসিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১১ বছরের জন্য, ২০২৫ সাল পর্যন্ত। এসব সিদ্ধান্ত এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।জনতা ব্যাংকে ২ ডিসেম্বর নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদ-উজ-জামান। তাঁর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত পর্ষদের দুটি সভায় ঋণগুলো পুনঃ তফসিলের এ সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে এ কে এম কামরুল ইসলাম জনতা ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকাকালে পর্ষদ ঋণগুলো পুনঃ তফসিলের বিষয়ে একাধিক দফা আলোচনা করে। তখনই পর্ষদ ঋণগুলো পুনঃ তফসিলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলেও ঋণের অর্থ বেক্সিমকো কীভাবে সংগ্রহ করবে, সেই তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু সেই তথ্য ছাড়াই পুনঃ তফসিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনতা ব্যাংক।যোগাযোগ করা হলে ওয়াহিদ-উজ-জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের পর্ষদ ঋণ পুনঃ তফসিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা তা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য পাঠাতে বলেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন দুই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া আর কোম্পানি চালু রেখে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়।’ব্যাংক সূত্র জানায়, বেক্সিমকো গ্রুপের কয়েকটি কোম্পানি নিজেদের মধ্যে পণ্য কেনাবেচা করতে জনতা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয়কে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিল ২০১০-১১ সালে। ব্যাংক খাত থেকে হল-মার্ক একই প্রক্রিয়ায় অর্থ বের করে নেয়। এমনিভাবে অগ্রণী, এক্সিম ব্যাংক থেকেও ঋণ সৃষ্টি করে বেক্সিমকো গ্রুপের কয়েকটি কোম্পানি। আর এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সটেক্স, বেক্সিমকো সিনথেটিক, ক্রিসেন্ট অ্যাকসেসরিজ, অ্যাসেস ফ্যাশন, ক্রিসেন্ট ফ্যাশনস, ইন্টারন্যাশনাল নিট ওয়্যার-১ ও ২।বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে আবেদন করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তাদের বস্ত্র ও পোশাক খাতের কয়েকটি কোম্পানির নেওয়া প্রায় পাঁচ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার ঋণ ২০২৬ সাল পর্যন্ত পুনঃ তফসিলের প্রস্তাব করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রস্তাব ও একটি চিঠি দিয়ে ব্যাংকগুলোর কাছে তা পাঠিয়ে দেয়। চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে, ‘আপনাদের নিজস্ব বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে এবং বিদ্যমান বিধিবিধানের আলোকে মতামত অত্র বিভাগে প্রেরণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’বেক্সিমকোর প্রস্তাবে বলা হয়, তাদের সব ঋণের সুদহার ১০ শতাংশে নির্ধারণ এবং আগামী আড়াই বছর পর্যন্ত মূল ঋণ ও তার সুদ পরিশোধ না করার বিশেষ সুযোগ (মোরেটোরিয়াম) দিতে হবে। আবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে বেক্সিমকোর ব্যাংক ঋণ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে উল্লিখিত ’০১ থেকে ’০৮ সময়েও বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানি ঋণ পুনঃ তফসিল ও বিভিন্ন ধরনের সুবিধা পেয়েছে এমন তথ্য-প্রমাণ ব্যাংকগুলোর কাগজপত্রে রয়েছে।ব্যাংক সূত্র জানায়, সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আরব-বাংলাদেশ ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, বিদেশি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিসহ অন্তত পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেক্সিমকো গ্রুপে দেওয়া ঋণ ও বিনিয়োগ পুনঃ তফসিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে।বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের সঙ্গে গত ১২ নভেম্বর মুঠোফোনে এ নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি বলেন, এই প্রথমবারের মতো তাঁরা একটা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্স কোম্পানি নিয়োগ দিয়ে পুনর্গঠন প্রস্তাবটি তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটা আপনাদেরও সমর্থন করা উচিত।’সালমান এফ রহমান আরও বলেন, গত তিন বছরে তাঁরা ব্যাংক খাতে ৮০০ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করেছেন। এগুলোর মধ্যে বড় অংশ তো অ্যাকোমোডেশন বিল, যা হল-মার্কও করেছিল—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, হল-মার্ক অস্তিত্বহীন কোম্পানি বানিয়ে অর্থ বের করে নিয়েছিল। কিন্তু এগুলো মোটেই সে ধরনের নয়, তাদের বড় বড় সব কোম্পানি আছে। গত বছরের শেষ ভাগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিদেশি ক্রয় চুক্তিগুলো বাতিল হওয়ায় এখন ঋণগুলো পুনর্গঠন করতে হচ্ছে। আর গত দুই দিনে কথা বলার জন্য সালমান এফ রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে খুদে বার্তাও পাঠানো হয়।সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, এই গ্রুপটি বারবার তাদের খেলাপি ঋণগুলো পুনঃ তফসিল করেছে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে তাদের এ কাজ চলছে। তাঁর ডেপুটি গভর্নর থাকাকালে একবার লম্বা সময়ের জন্য পুনঃ তফসিলের প্রস্তাব তারা করেছিল। তবে লম্বা সময় দেওয়া হয়নি।ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, এখন দেখার বিষয়, ২০২৬ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ অবাস্তব সময়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক পুনঃ তফসিলের অনুমোদন দেয় কি না। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করার পরামর্শ দেন।
শেয়ার করুন