আপডেট :

        নির্বাচনের ছাড়া এই মুহূর্তে বিএনপির কোনো রাজনীতি নেই

        হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায় আজ

        আসছে নতুন দল: উপদেষ্টা নাহিদ

        ঢাকায় এসে নিখোঁজ হওয়া সুবাকে দেখা গেল ক্যামেরায়

        ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ

        ইমিগ্রেন্ট ছাড়া একদিন: লস এঞ্জেলেসের প্রতিবাদ রাতেও অব্যাহত

        ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ

        মেক্সিকো ও কানাডার পণ্যে শুল্ক আরোপ স্থগিত, চীনের সঙ্গেও আলোচনা হবে

        যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে পাল্টা শুল্ক চীনের

        নিউইয়র্কে বাড়ির সামনে বাংলাদেশিকে গুলি

        হাসিনা-রেহানাদের ৪ বাগানবাড়ি, আছে ডুপ্লেক্স ভবনও

        বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কর্মকর্তার লকার ফ্রিজ করার নির্দেশ

        এবার ইউরোপে শুল্ক আরোপের হুমকি

        মৌলভীবাজারে যুবলীগ নেতা রুহুল আমিন আটক

        দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় আঘাত হানবে দুইটি ঝড়

        লস এঞ্জেলেসে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ, ১০১ ফ্রিওয়েতে তীব্র যানজট

        প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে গ্র্যামিতে কান্ট্রি অ্যালবামের পুরস্কার

        অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ

        এলিমিনিটরে লড়াইয়ের আগে দলের শক্তিও বাড়ায় রংপুর

        কিছুদিন পর দেখব খুনিরা বাইরে

সংকটে সাধারণ মানুষও

সংকটে সাধারণ মানুষও

জয়মনিঘোল গ্রামের নজরুল শেখের পেশা মাছ ধরা। কিন্তু তেলের ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ার পর থেকে মাছ ধরতে পারছেন না তিনি। কারণ জাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া মাছও ধরা পড়ছে না। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। দু'মুঠো ভাত জোগাড়ের জন্য নজরুল তার মা হাফিজাকে নিয়ে তেল সংগ্রহে নেমে পড়েছেন। গত মঙ্গলবার ভোরে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে যাত্রাবিরতি করে অয়েল ট্যাঙ্কার সাউদার্ন স্টার-৭। এ সময় টোটাল নামে অন্য একটি ট্যাঙ্কারের ধাক্কায় সাউদার্ন ডুবে যায় এবং সাউদার্নে বহন করা তিন লাখ ১৫ হাজার ৬৬৪ লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনের প্রায় ৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকায়। তেল কেবল নদীর পানিতে মেশেনি; জোয়ারের পানির সঙ্গে পেঁৗছে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনের বিস্তীর্ণ এলাকায়। ফলে বন্য ও জলজ প্রাণী থেকে শুরু করে বনসংলগ্ন এলাকার মানুষের বেঁচে থাকায় সংকট তৈরি হয়েছে।সংকটে সাধারণ মানুষও
নজরুল শেখ ও তার মা হাফিজার মতো শত শত নর-নারী এখন নদী থেকে তেল সংগ্রহের কাজ করতে শুরু করেছেন। শ্যালা নদীতীরে গত দু'দিন ধরে সরেজমিন সীমাহীন ভোগান্তির শিকার এমন অনেক মানুষের দেখা মিলেছে। সরকারি তেল বিপণন সংস্থা পদ্মা অয়েলের ঠিকাদাররা গতকালই প্রথমবারের মতো নদী থেকে আহরণ করা তেল কিনতে শুরু করেছেন। এমনই একজন ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম বাবুলের সঙ্গে দেখা হলো বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের অদূরবর্তী নদীতীরে। ঠিকাদার বাবুল সমকালকে জানালেন, মাত্র তিন দিন তারা এই তেল কিনবেন। তেলের দাম প্রতি লিটার সর্বোচ্চ তিরিশ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে।
তিন দিন পর কী হবে_ এ নিয়ে বিচলিত নজরুল ও হাফিজার মতো দিন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষ। জয়মনি গ্রামের জেলে মশিউর রহমান সানা উদাস দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন শ্যালা নদীর তীরে। তিনি জানালেন, চার দিন ধরে নদীতে জাল ফেলতে পারছেন না। যারা জাল ফেলছে তাদের জালে তেল জড়িয়ে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের আয়ের একমাত্র পথ বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা হয়েছে তার।একই গ্রামের জেলে বৃদ্ধ এখলাস শিকদার বলেন, ২১ বছর ধরে তিনি সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু এমন সংকটে কখনও পড়েননি। এখন কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। নদীতীরের বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন ও জলিল সানা জানান, তাদের হাঁসগুলো নদী-খালে নামতে পারছে না। নদীতে নামলে গায়ে ঘন ও কালো তেল জড়িয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে তারা হাঁস জবাই করে খাচ্ছেন, নয়তো বিক্রি করে দিচ্ছেন।মানুষের যখন এই অবস্থা, তখন বনজ ও জলজ প্রাণীর কী হবে? পরিস্থিতি পুরোপুরি বুঝতে আরও খানিকটা সময় লাগবে বলে জানালেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. নবিউল ইসলাম খান। তিনি সমকালকে বলেন, ফার্নেস অয়েল জোয়ারের সময় সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এই তেল বনের গাছের শ্বাসমূলে আটকে থাকার ফলে নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মারা পড়বে গাছগুলো। সাধারণত ছোট গাছের পাতা খেয়ে হরিণসহ যেসব প্রাণী জীবন ধারণ করে তারা মারা পড়বে। মরবে জলজ প্রাণী ও মাছ। তার ধারণা, আগামী ৩০ দিনের মধ্যে বিষয়টি দৃশ্যমান হতে শুরু করবে।
জয়মনিরগোল এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ শুকুর বলেন, এত দিন লাগবে না। এরই মধ্যে কাঁকড়া মরতে শুরু করেছে। তিনি নদীতীরে মরে পড়ে থাকা একটি কাঁকড়া দেখিয়ে বললেন, কাঁকড়ারা যেহেতু কাদামাটির নিচে থাকে, সেহেতু সবার আগে তারাই মরবে। জোয়ারের সময় ভেসে আসা তেল তো কাঁকড়াদের গর্তে ঢুকে যাচ্ছে। শুকুর জানালেন, ভাটির দিকে মাছও মরতে শুরু করেছে বলে খবর পেয়েছেন। তার আশঙ্কা, আগামী মধু সংগ্রহের মৌসুমে (এপ্রিল-মে) বনে বারবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটবে। ফার্নেস অয়েল লেগে থাকায় গাছগুলো ভয়াবহ রকমের দাহ্য বস্তুতে পরিণত হয়ে থাকবে। মৌয়ালিরা বনে গিয়ে বিড়ি-সিগারেট ফেলামাত্র আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে।এই পরিস্থিতিতে বন বিভাগ ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের একটি মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অবশ্য প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী বলছেন, এরই মধ্যে মামলা দায়ের করা হয়ে গেছে। মামলা করা হয়েছে বাগেরহাট জেলা আদালতে। গতকাল দুপুরে সমকালের সঙ্গে আলাপের সময় তিনি মামলার বাদী হিসেবে বন বিভাগের যে কর্মকর্তার নাম জানিয়েছেন, সেই আবুল কালাম আজাদ গতকাল সকালে বলেছিলেন, এখনও কোনো মামলা হয়নি। পরে দুপুরে আবার যোগাযোগ করা হলে বন বিভাগের স্টেশন কর্মকর্তা এই আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাহলে হয়তো মামলা হয়েছে। আমরা তো মামলা ফাইল করে স্টেশন থেকে রেঞ্জে পাঠিয়েছি। রেঞ্জ থেকে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে সেটি পাঠানো হয়েছে। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আমির হোসাইন চৌধুরীর সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট সব সূত্রে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এ পর্যন্ত মংলা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা ছাড়া বন বিভাগ আর কিছুই করেনি। প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী দাবি করেছেন, জিডিও এক ধরনের মামলা।সুন্দরবন পর্যবেক্ষণ দলের সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, আমাদের জানামতে এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা করা হয়নি। তা ছাড়া এ ব্যাপারে বন আইনে মামলা করা হলে অপরাধীরা গুরুপাপে লঘুদণ্ড নিয়ে বেরিয়ে যাবে। তার মতে, সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতিতে ১০০ কোটি টাকার মামলা করাটা হবে বোকামি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও মনে করেন, ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চাওয়াটা ঠিক হবে না। জাতিসংঘের মতো নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ নিরূপণ করা উচিত। মামলা করার আগেই ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কথা বলে কোনো পক্ষকে বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা উচিত। তিনি বলেন, এ ঘটনায় বন আইনেই মামলা করতে হবে_ এটা ঠিক নয়। মামলা করা উচিত পরিবেশ আইন অনুযায়ী। তবে সবার আগে ক্ষয়ক্ষতি কতটা কমানো যায়, তা-ই আমাদের করণীয়।এদিকে নদী ও খালের পানিতে তেলের দূষণ নিয়ন্ত্রণ কাজে বৃহস্পতিবার বিকেলে শ্যালা নদীতে এসে পেঁৗছে চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ কাণ্ডারী-১০। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত জাহাজটিকে শ্যালা নদীতে নোঙর করে থাকতে দেখা গেছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না মেলায় রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে শুরু করা হয়নি।
জাহাজটির দায়িত্বে নিযুক্ত চট্টগ্রাম পোর্টের পাইলট মাসুদ হোসেন জানান, জাহাজটিতে ১০ হাজার লিটার 'অয়েল স্পিল ডিসপারসেন্ট' নামের রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। এই রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে করার জন্য তারা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। অনুমতি পেলে কার্যক্রম শুরু করবেন। তবে গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় পাওয়া খবরে জানা গেছে, বন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নূরুল করিমের নেতৃত্বে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা বিশেষজ্ঞদের একটি দল নদীতে রাসায়নিক স্প্রে করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। একই সময়ে ঢাকায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সভায় অভিন্ন সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে। ফলে রাসায়নিক ছিটানো আপাতত স্থগিত রয়েছে। ঢাকার ওই সভায় খুলনা অঞ্চলের বন ও পরিবেশের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। আগামী রোববার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে। রোববারের ওই বৈঠকে নাগরিকদের সঙ্গে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে একটি কমিটি করে দেওয়া হবে। পরবর্তী ১৫ দিন ১৫টি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্যালা নদীর পানি সংগ্রহ করে রাসায়নিক পরীক্ষা করা হবে।প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন মামুন রেজা ও মনিরুল হায়দার ইকবাল

শেয়ার করুন

পাঠকের মতামত