৫৫ মিলিয়ন ডলারের মাদক বাজেয়াপ্ত, ৩ সন্দেহভাজন ফেন্টানাইল পাচারকারী গ্রেফতার
বলা হলো না শেষ কথাটি
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আর নেই
গাঢ় সবুজ আর টকটকে লালের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি আর প্রতিবাদী চেতনার লাল-ই বোধ হয় তার তুলিতে এনে দিত রঙের অন্তরঙ্গ গভীরতা। গভীর রঙের কারুকার, বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকর্মের পথিকৃৎ শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ঘন সবুজ মাঠেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। গতকাল রোববার রাত সাড়ে ৯টায় আর্মি স্টেডিয়ামের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হলে চিকিৎসকরা জানান, বরণ্যে এই চিত্রকর আর বেঁচে নেই (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। চলে গেলেন কাইয়ুম চৌধুরী
তিনি স্ত্রী চিত্রশিল্পী তাহেরা খানম ও এক পুত্র রেখে গেছেন। কাইয়ুম চৌধুরী একুশে ও স্বাধীনতা পদকসহ দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হন।
গত রাতের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবে বিশেষ অতিথি ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে রাত ৮টা ৪০ মিনিটে বক্তৃতা করে তিনি মঞ্চ থেকে নেমে আসেন। পরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বক্তৃতা দিতে মঞ্চে দাঁড়ালে তিনি ফিরেএসে বলেন, 'আমার একটি কথা বলার রয়েছে।' এ কথা বলেই তিনি মঞ্চে ঢলে পড়েন।
সিএমএইচের ডেপুটি কমান্ড্যান্ট কর্নেল ডা. জামিল আহমেদ গত রাতে সমকালকে জানান, রাত ৯টায় কাইয়ুম চৌধুরীকে হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়। রাত পৌনে ১০টার দিকে শিল্পীর মরদেহ সিএমএইচ থেকে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে নেওয়া হয়। সেখানে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর জানান, আজ সকাল ১০টায় কাইয়ুম চৌধুরীকে তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল চারুকলার গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগে নেওয়া হবে।
সেখান থেকে শিল্পীর মরদেহ শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নেওয়া হবে সকাল ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। জোহরের নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাজা। এর পর তাকে আজিমপুর কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শয়ান করা হবে।
কিংবদন্তি চিত্রকরের চিরবিদায়ের খবর পেয়ে শিল্পীর ভক্ত, অনুরাগী, সুহৃদ, স্বজনেরা স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান। শিল্পীর স্ত্রী তাহেরা বেগম হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শিল্পীর একমাত্র ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাইনুল ইসলাম জাবের মাকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী, মালেকা বেগম, হাসান আরিফ, আবুল মোমেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পরিচালক আবুল খায়ের লিটুসহ আরও অনেকেই হাসপাতালে যান। তারা শিল্পীর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ শোক বার্তায় বলেছেন, কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুতে জাতি একজন বরেণ্য সন্তান হারাল। রাষ্ট্রপতি শিল্পাঙ্গনে কাইয়ুম চৌধুরীর অবদানের কথা স্মরণ করে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব আলম শাকিল জানিয়েছেন, কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি শোক বিবৃতিতে বলেন, বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন এবং প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এই মহান শিল্পীর অগ্রণী ভূমিকা জাতি চিরদিন গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।
প্রধানমন্ত্রী তার আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোকাহত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া শোকবার্তায় বলেন, কাইয়ুম চৌধুরীর মৃত্যুতে শিল্পাঙ্গনে অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ শোক প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়াও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ শীর্ষ রাজনীতিকরা শোক জানিয়েছেন।
কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩২ সালের ৯ মার্চ ফেনীতে। পিতা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় পরিদর্শক। পিতার আগ্রহে তার শিল্পচর্চা শুরু। ১৯৫৪ সালে তিনি ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে ফাইন আর্টসে ডিগ্রি নেন। ১৯৫৭ সালে তিনি চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পঞ্চাশ দশকের শুরু থেকে আমৃত্যু কাইয়ুম চৌধুরী এ দেশের শিল্পকলার চর্চা ও বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রক্ষণশীল বাঙালিবাস্তবতায় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শিল্প আন্দোলনে কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন শিল্পাচার্যের অন্যতম সহযোগী; জয়নুলের পরে কামরুল হাসান ও কাইয়ুম চৌধুরীর হাতেই এ দেশের শিল্পকলা তার শেকড় ছোঁয়ার স্পর্ধা অর্জন করে।
বাংলা ক্যালিওগ্রাফি ও বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কনের ক্ষেত্রে কাইয়ুম চৌধুরী নিজেই এক প্রতিষ্ঠান। সনাতন বাংলা অক্ষরে একইসঙ্গে মাটিবর্তী প্রান্তিক ও নাগরিক মননের যৌথ বুনন ঘটে তাঁর হাতে। পুস্তকের প্রচ্ছদে বা পুটে অক্ষর দেখেই বুঝে নেওয়া যায়_ এই অক্ষর যার_ তিনি কাইয়ুম চৌধুরী। একইভাবে প্রচ্ছদে গাঢ় রঙ, বিশেষত সবজু আর লালের গভীর ছটায় তিনি নিজস্ব স্টাইলের সৃষ্টি করেন। ৬০ বছরে বিশ হাজারেরও বেশি প্রচ্ছদ এঁকেছেন তিনি; আমৃত্যু এ কাজে তিনি ছিলেন তরুণের প্রতিযোগী। আসছে বইমেলার জন্যও তিনি এরই মধ্যে এঁকে রেখেছেন কিছু প্রচ্ছদ।
বইয়ের প্রচ্ছদ ছাড়াও গ্রন্থের অঙ্গসৌষ্ঠব ও অলঙ্করণে তার আন্তর্জাতিক মান সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে তাকে সুপ্রিয় করে রেখেছে। এ দেশের পত্রিকার অঙ্গসজ্জায় কাইয়ুম চৌধুরীর ভূমিকা বিস্ময়কর। সেকেলে গতানুগতিকতার বাইরে সমকালীন বিবেচনাবোধকে সামনে রেখে তিনি এ দেশের বহু দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকার গ্রাফিক্স, মাস্টহেড, অলঙ্করণে বিশ্বমানের পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। দশকে দশকে বয়স বেড়েছে তাঁর; কিন্তু তিনি কাজে তরুণতর হয়েছেন প্রতিনিয়ত।
তাঁর ছাপ রয়েছে সমকালসহ এ দেশের সবক'টি মূল ধারার পত্রিকায়। সমকালের বিশেষ সংখ্যা, ঈদসংখ্যা, কালের খেয়ায় তাঁর আঁকা, চিন্তা, পরামর্শ উৎকীর্ণ হয়ে আছে। কবিতায় আগ্রহ ছিল তাঁর ব্যাপক; লিখতে ভালোবাসতেন কবিতা। এ দেশের সব প্রধান কবির সঙ্গে ছিল তাঁর বিশেষ সখ্য; বিশেষত শামসুর রাহমান ও সৈয়দ শামসুল হক তাঁর দুই অভিন্ন হৃদয়সঙ্গী; শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' (১৯৫৯)-এর প্রচ্ছদ আঁকেন তিনি।
সেই থেকে শামসুর রাহমানের ৬০টি কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ প্রচ্ছদ কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা। সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে তার মননের বন্ধুত্ব আমৃত্যু অটুট ছিল। সৈয়দ হক এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, 'আমার হৃদয়বন্ধু আর নেই। এমন নিঃসঙ্গ মুহূর্তে কথা বলতে মন চায় না। শুধু বলি, চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী এ দেশে অসামান্য এক উদাহরণ; তাঁর কাজে, তাঁর মননে, তাঁর বোধে। কবিতার, ছবির, বইয়ের নতুন নতুন পরিকল্পনা সারাটি জীবন ধরে করেছি আমি তার সঙ্গে।'
শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী বলেন, 'কাইয়ুম চৌধুরী শিল্পকর্মে আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে দেশজ ভাবনার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। কত মাধ্যমেই না তাঁর কাজ- তেল, জল, কালি, কলম, মোমরঙ, রেশম-ছাপ, এমনকি তাঁর ব্যবহারিক শিল্পকাজগুলো- বইয়ের প্রচ্ছদ, সড়ক বিজ্ঞাপন, নানা প্রতিষ্ঠান ও সমাবেশ-সম্মেলনের জন্য আঁকা লোগো, ডিজাইন, নকশা এবং বাংলা অক্ষররূপ- এক্ষেত্রে তার উদ্ভাবন বাংলালিপির হাজার বছরের ইতিহাসে অনন্য। প্রতিটি কাজেই কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর দৃষ্টি ও অন্তরের গভীরে বাংলাকে ধারণ করেছেন।
শিক্ষকতা, পত্রিকার গ্রাফিক্স-অলঙ্করণ, সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ইত্যাদির পরও চিত্রকর্মই ছিল কাইয়ুম চৌধুরীর প্রধান আরাধ্য। পল্টনের গাজী ভবনের বিশাল স্টুডিওতে ধ্যানমগ্ন কাইয়ুম চৌধুরী দিনের পর দিন এঁকে গিয়েছেন তেলচিত্র, রেখাচিত্র, জলরঙ, ছাপচিত্রসহ শিল্পের যথাসম্ভব সব মাধ্যমে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলার চিরকালের কৃষক, কৃষাণি, প্রান্তিক নারী, ষড়ঋতু, পাখি, ফুল- এই সবই ছিল কাইয়ুম চৌধুরীর প্রিয় বিষয়।
বিশেষত গ্রামবাংলা- তার অভাব, প্রকৃতি, মানুষ, সৌন্দর্য আর সম্ভাবনা বারবার কাইয়ুম চৌধুরীর ছবির প্রতিপাদ্য হয়েছে। আর কাইয়ুম চৌধুরীর গাঢ় রঙের ব্যবহার। তাঁর শিল্পকর্মেই সবচেয়ে গভীরব্যঞ্জনায় ধরা পড়েছে। হয়তো আবেগী বাঙালির গাঢ় ভালোবাসার অনুবাদ করতেই কাইয়ুম চৌধুরী বেছে নিয়েছিলেন এই রঙ। পাকিস্তানি আগ্রাসন ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের প্রশ্নে আপসহীন এই শিল্পী দশকের পর দশক ছবি এঁকেছেন, কার্টুন এঁকেছেন; সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে তিনি সরব থেকেছেন। উত্তরপ্রজন্মের সকল শিল্পীই তার ছাত্র; অনেকেই সরাসরি, অনেকে কাজ-কার্যক্রম দেখে। কাইয়ুম চৌধুরীর হৃদয়বিদারক মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গতকাল রাতেই তার ছাত্রছাত্রী, সংস্কৃতি জগতের সকলেই গভীর বিষাদে আচ্ছন্ন হন।
ব্যক্তিজীবনে অমায়িক, মৃদুভাষী, আড়ম্বরহীন কাইয়ুম চৌধুরী থাকতেন আজিমপুরে ছোট্ট এক বাসায়। পল্টনে বহুতল ভবনে ফ্ল্যাট থাকলেও আড়ম্বরহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত তিনি পুরনো বাসভবনেই কাটিয়ে দিয়েছেন সারাজীবন।এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, 'আড়ম্বরহীন কাইয়ুম চৌধুরীর রুচিবোধ ও ব্যক্তিত্ব ছিল প্রখর। প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর সমাজ গঠনে তিনি তার শিল্পকর্মকে ব্যবহার করেছেন রুচি ও মননের নিবিড় স্পর্শে।'
শেয়ার করুন