সারকারখানার উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে দেশের প্রায় ৪শ হিমাগার
ফেঞ্চুগঞ্জ শাহজালাল সারকারখানার উপর নির্ভর হয়ে পড়েছে দেশের প্রায় ৪শ হিমাগার। দেশের অন্যান্য সারকারখানা বন্ধ থাকায় হিমাগার পরিচালনার প্রধান ক্যামিকেল-তরল অ্যামোনিয়া গ্যাস সংগ্রহ করা হচ্ছে এই একটিমাত্র সারকারখানা থেকে। কৃষিপণ্য সংরক্ষণ মৌসুম মার্চ-এপ্রিলে তরল অ্যামোনিয়ার সংকট আশংকায় উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ সমিতি। সারাদেশের সিলিন্ডারবাহী ট্রাকের স্রোত এখন ফেঞ্চুগঞ্জমুখী। বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক ছুটে আসছে ফেঞ্চুগঞ্জে, কিন্তু চাহিদার তুলনা সরবরাহে সীমাবদ্ধতা থাকায় সিলিন্ডারবাহী ট্রাকগুলোকে সারকারখানা ফটকে সিরিয়াল পেতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ৭/৮ দিন।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, বোটলিং প্লান্টে ২টি মোটরের একটি ছিল স্ট্যান্ডবাই। বেশ কিছুদিন আগে একটি মোটর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে বিদ্যমান একটিমাত্র মোটর দিয়ে গ্যাস ফিলিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চলমান মোটরে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে বন্ধ হয়ে যাবে আ্যামোনিয়া সরবরাহ কার্যক্রম। গত বছরের তুলনায় এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। এতে হিমাগারগুলোতে আলুর ধারণ ক্ষমতার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেও সংরক্ষণ মৌসুমে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংকটে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) ৬টি বৃহৎ ইউরিয়া সারকারখানায় হিমাগারের এই আ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপাদন হয়। সারকারখানার টেকনিক্যাল বিভাগ জানায়, তরল অ্যামোনিয়া হচ্ছে ইউরিয়া ও অ্যামোনিয়া সারের মধ্যবর্তী একটি প্রোডাক্ট। ইউরিয়া ও অ্যামোনিয়ার মূল কাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাস (মিথেন) বাতাস ও পানি।
দেশের অন্যান্য ইউরিয়া সারকারখানায় হিমাগার ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত তরল অ্যামোনিয়া উৎপাদন হতো কিন্তু বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে গ্যাস সংকটজনিত কারণে দেশের অন্যান্য ৫টি সার কারখানা বন্ধ রাখা হয়। এক্ষেত্রে সিলেটের শাহজালাল সারকারখানাও গ্যাস সংকটে কিছুদিন বন্ধ রাখলেও বিগত বছর থেকে সিলেটের এই সারকারখানাকে চালু রাখা হয়।
ফেঞ্চুগঞ্জে নবনির্মিত শাহাজালাল সারকারখানায় উৎপাদন শুরু হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। দৈনিক ১৭৬০ মেট্রিক টন দানাদার ইউরিয়া ও ১০০০ মেট্রিক টন আ্যামোনিয়া উৎপাদনের লক্ষ্যে চায়নার মেসার্স কমপ্লান্ট ফেঞ্চুগঞ্জে শাহাজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড নামের এই সারকারখানা স্থাপন করে। এতে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ৫হাজার কোটি টাকা।
শাহাজালাল সারকারখানা থেকে বিসিআইসির এনলিস্টেড ৭৯ জন ডিলার দেশের হিমাগার ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য নিয়মিত তরল আ্যামোনিয়া সংগ্রহ করেন। সারকারখানার বিক্রয় শাখা জানায়, চাহিদা বেশী থাকলেও বর্তমানে ৫০ কেজির ধারণ ক্ষমতার সিলিন্ডারে দৈনিক ২৫০ থেকে ৩০০ সিলিন্ডার ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। ৫০ কেজির প্রতিটি আ্যামোনিয়া ভর্তি সিলিন্ডারের বিক্রয় মূল্য ৩৭২০ টাকা রাখা হচ্ছে।
শাহাজালাল সারকারখানায় ৫ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতার ২টি আ্যামোনিয়ার রিজার্ভ ট্যাংক রয়েছে। অ্যামোনিয়া থেকেই ইউরিয়া সার তৈরী করা হয়। শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক কর্মকর্ত জানান, গত প্রায় ৩মাস পূর্বে আ্যামোনিয়া সেকশনের বোটলিং প্লান্টের একটি মোটর নস্ট হয়। ইতিমধ্যে দেশীয় প্রকৌশলীরা কয়েক দফা চেষ্টা করে মোটরটিকে সচল করতে পারেননি। চলমান মোটরে যান্ত্রিক ত্রুিিট দেখা দিলে অ্যামোনিয়া ফিলিং কার্যক্রম পুরোদমে বন্ধ হয়ে যাবে বলে ওই কর্মকর্তা জানান।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ এসোসিয়েশনের সভাপতি মো: মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জানান, বছরের মার্চ মাস হচ্ছে কৃষিপণ্য বিশেষ করে আলু সংরক্ষণের মৌসুম। দেশে প্রায ৪শ হিমাগারে এবার আলু সংরক্ষণের কার্যক্রম চলছে। ধারণ ক্ষমতার ৪৫ লাখ মেট্রিক টন আলু এবার সংরক্ষণ করার সম্ভাবনা থাকলেও হিমাগার পরিচালনার প্রধান উপাদান তরল আ্যামোনিয়ার সংকটে সংশ্লিষ্ট সবাই উদ্বিগ্ন। বর্তমানে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে এই অ্যামোনিয়া গ্যাস। সময়মতো পর্যাপ্ত অ্যামোনিয়া না পাওয়ার কথা জানান তিনি। বর্তমানে কোল্ড স্টোরেজে সপ্তাহে প্রয়োজন কমপক্ষে ২০০ বোতল সিলিন্ডার কিন্ত সারকারখানা থেকে সাপ্তাহিক বরাদ্দ দেয়া হয় মাত্র ৫০ বোতল সিলিন্ডার। এ ক্ষেত্রে ডিলারদের কাছ থেকে ক্রয় করতে গিয়ে হিমাগার মালিকদেরকে বেশী মূল্য পরিশোধ করতে হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে সভাপতি জানান, গত বছরের তুলনায় এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। দেশে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ মেট্রিক টন হলেও এবছর আলুর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ মোট্রিক টন। হিমাগার পরিচালনায় তরল অ্যামোনিয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই বর্তমানে উদ্বেগ উৎকন্ঠায় রয়েছেন বলে তিনি জানান।
কুমিল্লা জেলার আল হেলাল কোল্ড স্টোরেজের স্বত্তাধিকারী ফারুক আহমদ জানান, কোল্ড স্টোরেজগুলোতে আলু, পেঁয়াজ, আদা, মাছ, ফলমুলসহ কৃষিপণ্য রাখা হয়। উন্নয়নশীল দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশষ্য সংরক্ষণে সরকারগুলো ভর্তুকি দিলেও বাংলাদেশ এ খাতে কোনো ভর্তুকি দিচ্ছে না। ফলে কোল্ড স্টোরেজগুলো নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে কোনোমতে হিমাগারগুলো টিকিয়ে রেখেছে।
শাহজালাল সারকারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আশরফুল ইসলাম জানান, শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানির মধ্যবর্তী প্রোডাক্ট হচ্ছে তরল অ্যামোনিয়া গ্যাস। এই সারকারখানার উৎপাদনের মূল আইটেম ইউরিয়া ও অ্যামোনিয়া সার। দেশে ক্রমবর্ধমান সারের চাহিদা বিবেচনায় এটি স্থাপন করা হয়। বর্তমানে দৈনিক প্রায় ১ হাজার মেট্রিক টন সার উৎপাদন হচ্ছে শাহজালাল সারকারখানায়। ইউরিয়া, অ্যামোনিয়া উৎপাদন করতে গিয়ে তরল অ্যামোনিয়া গ্যাস পাওয়া যায়, যা হিমাগার ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়। হিমাগারের চাহিদার সব অ্যামোনিয়া এখান থেকে দেয়া সম্ভব হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে উৎপাদন অনুযায়ী দৈনিক ১০-১৫ মেট্রিক টন তরল অ্যামোনিয়া গ্যাস সিলিন্ডারের ম্যাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। জানতে চাওয়া হলে বোটলিং প্লান্টের মোটর প্রসঙ্গে তিনি জানান, একটি মোটর গত কিছুদিন পূর্বে নষ্ট হয়েছে বর্তমানে মোটরটি মেনটেইনেন্সে আছে এটিকে সচল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন