'স্বল্প সময়ের নোটিশ’
বিক্ষোভকারীদের দমনে শক্তি প্রয়োগ অর্থাৎ গুলি না চালানোর যে সিদ্ধান্ত নেয় সেনাবাহিনী, মূলত তাতেই নির্ধারণ হয়ে যায় শেখ হাসিনার ক্ষমতার ভাগ্য। সেনাপ্রধানের এই বার্তা খুবই পরিষ্কার ছিল মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, তখনই বোঝা গেছে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর সমর্থন হারিয়েছেন।
গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগের রাতে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান জেনারেলদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, কারফিউ বলবৎ করতে বেসামরিক মানুষের ওপর সেনারা গুলি চালাবে না।
এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, এমন দুজন সেনা কর্মকর্তা রয়টার্সকে বিষয়টি জানিয়েছেন।
কীভাবে শেখ হাসিনার পতনের ঘণ্টা বাজল সে বিষয়ে বুঝতে পদত্যাগের আগের ৪৮ ঘণ্টার ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করেছে রয়টার্স।
বার্তা সংস্থাটি বলছে, পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া একজন ভারতীয় কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেনারেলদের সঙ্গে বৈঠকে পর সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে তাকে জানিয়ে দেন, তিনি যেমনটি চাচ্ছেন সেভাবে সেনা সদস্যদের পক্ষে অবরোধ কার্যকর করা সম্ভব নয়।
সেনাপ্রধানের এই বার্তা খুবই পরিষ্কার ছিল মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, তখনই বোঝা গেছে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর সমর্থন হারিয়েছেন।
শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে অনলাইন বৈঠক এবং সেনাবাহিনীর সমর্থন হারানোর বিষয়ে শেখ হাসিনাকে দেওয়া সেনাপ্রধানের বার্তা সম্পর্কে এর আগে বিস্তারিত খবর হয়নি।
এই ঘটনাবলি সোমবার কীভাবে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের আকস্মিক ও বিশৃঙ্খল ইতি ঘটাল, তা বিশ্লেষণে সহায়তা করবে। তার শাসনামলে তিনি ভিন্নমতকে খুব কমই সহ্য করেছেন। অবশেষে দেশ ছেড়ে তাকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে।
ছাত্রদের নেতৃত্বে জুলাই থেকে শুরু হওয়া হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের রোববারই (৪ অগাস্ট) ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিন, যেদিন দেশজুড়ে সংঘাতে ৯১ জন নিহত হয় এবং কয়েকশ মানুষ আহত হয়। এরপরই আবার দেশজুড়ে জারি হয় (অনির্দিষ্টকালের) কারফিউ।
ওই দিন বিকালে সেনা কর্মকর্তাদের বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সামি উদ দৌলা চৌধুরী। তিনি অবশ্য বলেছেন, যে কোনো সমস্যার পর ঘটনার সর্বশেষ তথ্য নিতে নিয়মিত বৈঠক ছিল সেটি। ওই বৈঠকে ঠিক কী সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সে বিষয়ে আরও জানতে চাইলে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।
মন্তব্য জানতে শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ কারা যায়নি। তার ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের মন্তব্য চেয়ে বারবার অনুরোধ করা হলেও তাতে সাড়া দেননি তিনি।
শেখ হাসিনার শাসনের শেষ ৪৮ ঘণ্টা সম্পর্কে বুঝতে গত সপ্তাহের ঘটনাবলি সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত রয়েছেন, এমন ১০ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। তাদের মধ্যে চারজন বর্তমান সেনা কর্মকর্তা এবং দুজন এমন ব্যক্তি রয়েছেন, ঘটনা সম্পর্কে যাদের অবহিত করা হয়েছে। তবে স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তারা কথা বলেছেন।
গত ৩০ বছরের মধ্যে ২০ বছর শাসন করেছেন শেখ হাসিনা। বিরোধী দলগুলোর হাজারো নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার এবং প্রধান বিরোধীদের নির্বাচন বয়কট করার মধ্যে গত জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবারের মত ১৭ কোটি মানুষের দেশে নির্বাচনে জয়ী হন তিনি।
উচ্চ বেকারত্বের মধ্যে খুবই আকাঙ্ক্ষিত সরকারি চাকরিতে নির্দিষ্ট অংশের মানুষের জন্য কোটা সংরক্ষেণে আদালতের এক সিদ্ধান্তের পর শুরু হওয়া আন্দোলনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ক্ষমতার ওপর শেখ হাসিনার কঠোর নিয়ন্ত্রণ। আদালতের সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হলেও খুবই দ্রুতই আন্দোলন মোড় নেয় শেখ হাসিনাকে উৎখাতের দাবিতে।
সেনাবাহিনীর সাবেক তিনজন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের প্রকাশ্য ঘোষণা দেননি সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। তবে বিক্ষোভের পরিসর এবং ২৪১ জনের মৃত্যু শেখ হাসিনাকে যে কোনো মূল্যে সমর্থন দেওয়ার পথ রুদ্ধ করে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, “সেনাদের মধ্যে ব্যাপক অস্বস্তি ছিল। বিষয়টি হয়ত সেনাপ্রধানের ওপর চাপ তৈরি করেছিল। কারণ, সেনারা বাইরে ছিল, কী কী ঘটছে তারা তা দেখছিলেন।”
বৈবাহিক সূত্রে শেখ হাসিনার আত্মীয় ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি যে আর প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন করছেন না, তার ইঙ্গিত পাওয়া শনিবারের এক বৈঠক থেকে। ওই দিন অলংকৃত কাঠের চেয়ারে বসে উর্দিধারী কয়েকশ কর্মকর্তার উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। ওই বৈঠকের কিছু বিষয় পরে প্রকাশ্যে আনে সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বলেছেন, জেনারেল (সেনাপ্রধান) ঘোষণা দেন জীবন বাঁচাতে হবে এবং সেনা কর্মকর্তাদের সংযম দেখানোর আহ্বান জানান।
শক্তি প্রয়োগ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে সহিংস আন্দোলনকারীদের দমন করবে না, এটি ছিল তার প্রথম লক্ষ্মণ। বিষয়টি হাসিনাকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।
সাবেক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সোমবার যারা রাস্তায় নামেন তাদের মধ্যে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ শাহেদুল আলম খান বলেন, “সেনাবাহিনী আমাদের আটকায়নি। সেনাবাহিনী যেটা বলেছিল, তারা সেটা করেছে।”
'স্বল্প সময়ের নোটিশ’
পূর্ণদিবস কারফিউয়ের প্রথম দিন সোমবার শেখ হাসিনা ছিলেন গণভবনে, যেটি ঢাকার সর্বাধিক সুরক্ষিত ভবনের একটি এবং এটি ছিল তার আবাসিক কার্যালয়।
বাইরে বিস্তৃর্ণ শহরের রাস্তায় রাস্তায় সেদিন হাজার হাজার মানুষ নেমেছিল। আন্দোলনকারী নেতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে লাখো জনতা রাস্তায় নেমে এসেছিল। তারা শহরের প্রাণ কেন্দ্রে ঢুকে পড়েছিল।
ঘটনাগুলো খুব কাছ থেকে জানেন- এমন দুজন বাংলাদেশি এবং একজন ভারতীয় কর্মকর্তা ভাষ্য অনুযায়ী, পরিস্থিতি ক্রমেই তার হাতছাড়া হওয়ায় ৭৬ বয়সি নেতা শেখ হাসিনা সোমবার সকালেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বাংলাদেশের একটি সূত্র বলছে, লন্ডনে বসবাস করা শেখ রেহানা সোমবার গণভবনে ছিলেন। বোনের সঙ্গে শেখ হাসিনা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। একসঙ্গে তারা দেশ ছেড়ে চলে যান। সোমবার স্থানীয় সময় মধ্যাহ্নভোজ গ্রহণের সময় তারা দেশ ত্যাগ করেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার ভারতের পার্লামেন্টকে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানান, “ (বাংলাদেশে) যোগাযোগ থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে নিতে জুলাইজুড়ে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।”
তবে কারফিউ উপেক্ষা জনতা ঢাকা শহরে ঢুকে পড়ায় “নিরাপত্তা প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকের পর শেখ হাসিনা পদত্যাগে সিদ্ধান্ত নেন,” পার্লামেন্টকে বলেন জয়শঙ্কর।
“ওই পরিস্থিতিতে স্বল্প সময়ের নোটিশে তিনি (শেখ হাসিনা) ভারতের প্রবেশের অনুমোদন দিতে অনুরোধ করেন,” যোগ করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
আরেকজন ভারতীয় কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কূটনৈতিকভাবে শেখ হাসিনাকে বলে দেওয়া হয়েছে ভারতের তার অবস্থানকাল হবে সাময়িক। কারণ, তা না হলে ঢাকার পরবর্তী সরকারের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কের অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়ায় হলেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ছাত্ররা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চাইছেন। নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে ড. ইউনূস বলেছেন, “ভুল লোকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করেছে ভারত... দয়া করে পররাষ্ট্রনীতি পুনর্মূল্যায়ন করুন।”
ড. ইউনূসের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করতে পারেনি রয়টার্স।
সোমবার দুপুরে ঢাকা থেকে আগরতলা হয়ে দিল্লির কাছে হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন তার ছোট বোন শেখ রেহানা। সেখানে সেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে ভারত। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন এবং দেশটির রাজনৈতিক এলিটদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন।
দেশে ফেরার কয়েক বছর পর ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসেন শেখ হাসিনা। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের চেয়ে ভারতের নিরাপত্তাকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সংখ্যালঘুদের প্রতি শেখ হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গিও হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, বাংলাদেশের ১ কোটি ৩০ লাখ হিন্দুর নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তিনি।
এদিকে বাংলাদেশে এখনও শেখ হাসিনার প্রতি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। বিশেষ করে সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে, যাদের অবসরে যেতে বাধ্য করেছেন শেখ হাসিনা।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ শাহেদুল আলম খান রয়টার্সকে বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে “আমি মনে করি, তাকে নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া ঠিক হয়নি। এটা বোকামি ছিল।”
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
শেয়ার করুন