ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ফেসবুক, টুইটারসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। সত্য ধামাচাপা দিতে ধর্ষক বা নিপীড়কেরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মেসেজ, ছবি, কমেন্ট ইত্যাদি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন একটা আবহ তৈরি করার চেষ্টা করে, যাতে ধরা পড়ে গেলেও ঘটনাটিকে ‘দ্বিপক্ষীয় সম্মতি’ বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যায়। যুক্তরাজ্যে ধর্ষণ নিয়ে পুলিশ এবং সরকারি আইনজীবীদের এক সম্মেলনে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। যৌন নিপীড়নের সাক্ষ্যসহ এসব ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত জানুন দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে এই প্রতিবেদনে। সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে বিশ্বের নানা দেশেই বিভিন্ন অপরাধের সাক্ষ্যপ্রমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে আজকাল। এই সুযোগ নিয়ে মামলার তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করতে এবং সম্ভব হলে ঘটনাটিকে দ্বিপক্ষীয় সম্মতির বলে চালিয়ে দিতে তৎপর অপরাধীরা। বুধবার লন্ডনে ধর্ষণ নিয়ে এক সম্মেলনে এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। অপরাধ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের প্রধান সংস্থা সিপিএস বা ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস এবং পুলিশ যৌথভাবে ওই সম্মেলনের আয়োজন করে। সিপিএস-প্রধান অ্যালিসন সনডার্স বলেন, ধর্ষকেরা অপরাধ সংঘটনের পর ‘মিথ্যা কাহিনি’ সাজানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করতে পারে। এমন একটা কৌশল হলো, ধর্ষণের পরদিন ধর্ষিতার সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মেসেজ পাঠিয়ে তাঁকে ‘যৌন সম্পর্ক’ বা ‘সঙ্গমের’ জন্য ধন্যবাদ জানানো। এ অবস্থায় ধর্ষিতা ভাবতেই পারেন যে, এই মেসেজকে কাজে লাগিয়ে তিনি বিচার পেতে পারেন। কিন্তু এই ফাঁদ ঠিকমতো বুঝতে না পারলে ধর্ষিতা ভুল করে বসতে পারেন এবং মামলার কৌঁসুলিরাও এতে বিভ্রান্ত হতে পারেন। এ ধরনের সমস্যাকে বোঝার জন্য পুলিশ এবং সরকারি কৌঁসুলিরা একটা কল্পিত মামলার শুনানিতে অংশ নেন। মামলার বিবরণী এখানে তুলে ধরা হলো-‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম সপ্তাহেই ১৮ বছরের এক ছাত্রী কয়েক বছরের বড় এক ছাত্রের সঙ্গে নবাগতদের একটা পার্টিতে যান। মেয়েটি বেশি মাত্রায় মদ্যপান করে ফেলেন এবং অন্য কিছু মাদকও নেন। একসময় চেতনা ফিরলে মেয়েটি দেখতে পান, তিনি নিজের ঘরে আছেন এবং ছেলেটিও তাঁর সঙ্গে তাঁরই বিছানায় শুয়ে আছেন। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ছেলেটি সেখান থেকে যেতে চাচ্ছেন না এবং তাঁকে বিবস্ত্র করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। একসময় মেয়েটি বুঝতে পারেন ছেলেটি তাঁকে ধর্ষণ না করে ছাড়বেনই না। অনেক কাকুতি মিনতি সত্ত্বেও ছেলেটি তাঁকে রেহাই না দিলে মেয়েটি নিজের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য ছেলেটিকে কনডম ব্যবহার করার অনুরোধ জানান।’মামলার এই বিবরণী পড়ে শোনানোর পর সম্মেলনে উপস্থিত লোকজনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এই ঘটনায় ছেলেটির বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হবে কি না? উপস্থিত লোকজনের বেশির ভাগ সদস্যই হাত তুলে ছেলেটিকে ধর্ষণের আসামি হিসেবে বিচারের পক্ষে মত দেন। তবে উপস্থিত সবাইই কৌঁসুলি ছিলেন না। এক কৌঁসুলি বলেন, ‘ঘটনাটি কীভাবে শেষ হয়েছে, তা দেখতে হবে। ’ আরেকজন বললেন, ‘ছেলেটি কি বাকি রাতটা মেয়েটির ঘরেই ছিল? ছেলেটি কি পরদিন মেয়েটিকে ফুল পাঠিয়েছিল? ’কল্পিত মামলার এমন নানা পরিস্থিতি নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয় সম্মেলনে। পুলিশ কর্মকর্তা এবং সরকারি কৌঁসুলিরা একমত হন যে, এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্ষক বা অপরাধী এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। তবে, খুব ভালো করে বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে, ভবিষ্যতে কাজে লাগানোর জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো মেসেজ, কমেন্ট, ছবি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে কি না। পুলিশ কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়ে জানান, অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী ঘটনার শিকার ব্যক্তির সঙ্গে ‘অতিরিক্ত বন্ধুত্ব দেখিয়ে কিংবা আবারও এমন কিছুর নিশ্চয়তা চেয়েও’ যোগাযোগ করতে পারে। কিংবা এ রকম কোনো ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত নয় বরং স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা’ হিসেবে দেখানোর জন্যও অপরাধী তাঁর জাল বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধবদের কাছে নিজে থেকে আগেই ঘটনার মিথ্যা বিবরণ দিয়ে রাখা এমনকি ঘটনার শিকার ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগও আনতে পারেন অপরাধী। সম্মেলনে আরও জানানো হয়, যুক্তরাজ্যে গত দুই বছরে ধর্ষণ মামলার সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু আলোচিত মামলার প্রভাব এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের অতীতের নানা যৌন নিপীড়নের ঘটনা ও মামলা প্রবলভাবে আলোচিত হওয়ায় এটা বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়ন-বিষয়ক জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার মার্টিন হিউয়িট সম্মেলনে বলেন, ‘ধর্ষণের ঘটনায় নালিশ জানানোর এই হার বাড়াকে আমি দ্বিধাহীনভাবে স্বাগত জানাই। আমি চিন্তিত নালিশ না জানানোর ঘটনা নিয়ে। বাস্তবতা হলো, আমরা এখনো এমন নিপীড়নের ঘটনার মাত্র ২০ থেকে ২৫ ভাগের খবর পাচ্ছি। নিপীড়িত বা ধর্ষিত হচ্ছেন, এমন প্রায় ৭৫ ভাগই নালিশ জানাতে আসছেন না। ’সিপিএস-প্রধান অ্যালিসন সনডার্স বলেন, ‘বহু আগে থেকেই ধর্ষিতার সম্মতি নিয়ে বিভ্রান্তির বিষয়টি সমাজে জারি আছে। অতিরিক্ত মদ্যপ হয়ে যাওয়া এমনকি উত্তেজক পোশাক পরা নিয়েও এই বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এমন নিপীড়নের শিকাররা মোটেই বিভ্রান্ত নন। আমাদের সমাজটা বিভ্রান্ত এবং সেই সমাজকে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। আর সম্মতির বিষয়টি আইনে স্পষ্ট ব্যাখ্যা করা আছে এবং সেই সম্মতি অবশ্যই পুরোপুরি হতে হবে, স্বাধীন সম্মতি হতে হবে। ’‘মদ পান করা অপরাধ না, কিন্তু মাতাল হয়ে যাওয়ায় সম্মতি দিতে সক্ষম নন এমন কাউকে টার্গেট করে ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা করা অপরাধ। আসলে সেই পুরোনো কথাই বলতে হয়, না মানে তো না-ই। আর এটাও প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ধর্ষণের শিকার অনেক নারীই শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে নিজেকে রক্ষা করার, নিজের ক্ষতি কমানোর কৌশল হিসেবে নিস্তেজ হয়ে হাল ছেড়ে দেন। ’ব্রিটেনের ২০০৩ সালের যৌন অপরাধ আইনের ৭৪ ধারা অনুযায়ী কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্কের সম্মতি অবশ্যই এমন হতে হবে যেখানে সম্মতিদাতা সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম অবস্থায় আছেন এবং স্বাধীনভাবে তা করতে পারছেন। এই সম্মতি এক ধরনের যৌনক্রিয়ার জন্য হ্যাঁসূচক এবং অন্য ধরনের যৌনক্রিয়ার জন্য নাসূচক হতে পারে। কিংবা এই সম্মতি শর্তসাপেক্ষও হতে পারে-যেমন কনডম পরা। সম্মতিদাতা এই সম্মতি এমনকি যৌনক্রিয়া চলাকালেও যেকোনো সময় প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। আর একবারের সম্মতি মানেই বরাবরের সম্মতি নয় বরং প্রতিবার যৌনক্রিয়ার জন্যই আলাদাভাবে এই সম্মতি থাকতে হবে।