আন্তর্জাতিক

ট্রাম্প যুদ্ধ থামাতে চান কতটা ছাড় দিয়ে?

২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। এই যুদ্ধের ফলে ইউরোপে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিশ্বরাজনীতির ভারসাম্য উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে যাচ্ছে। ২০২২ সালে যুদ্ধের প্রথম দিকে আন্তালিয়া কূটনৈতিক সম্মেলন এবং ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত আলোচনা কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছিল । কিন্তু খুব দ্রুতই সেই আলোচনা ব্যর্থ হয় এবং দুই পক্ষ সামরিক কার্যক্রম বাড়িয়ে তোলে । এর ফলে যুদ্ধের মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রা আরো বেড়ে যায়। ট্রাম্প মার্কিন নির্বাচনের আগে থেকেই দাবি করে আসছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পারবেন। এই বক্তব্য তার রাজনৈতিক প্রচারণার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প কি সত্যিই যুদ্ধ শেষ করতে পারবেন? যদি পারেন, তাহলে তার কৌশল কী হবে? ট্রাম্পের কৌশল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তার জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ শুধু একটি অন্তর্জাতিক সংকট নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক হাতিয়ার। তিনি মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেবে, ইউরোপের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়ে দেবে এবং রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষের ঝুঁকি তৈরি করবে। ট্রাম্প বারবার বাইডেন প্রশাসনের নীতিকে ব্যর্থ বলেছেন, তিনি মনে করেন, বাইডেনের কৌশলযুদ্ধের সমাপ্তির কোনো বাস্তবসম্মত সমাধান দেখাতে পারবে না। ট্রাম্পের মতে, এই যুদ্ধ কেবল কূটনৈতিক উপায়ে সমাধান করা সম্ভব, যা একটি চুক্তির মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে হতে পারে । তিনি বিশ্বাস করেন যে, এই যুদ্ধ চীনের জন্য সবচেয়ে বেশি লাভজনক, কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার মতো একটি তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপক্ষের দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে বাধ্য করছে । এজন্য যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, ততই চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব নেতৃত্বের জন্য বিপজ্জনক । ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেন। তখন তিনি ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই একতরফাভাবে নীতিগত পরিবর্তন এনেছেন। তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে চাপ দেন, যে চুক্তি অনুযায়ী ইউক্রেনের প্রাকৃতিক ও বিরল খনিজ সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যাবে। যখন জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় নেতারা তার কাছ থেকে রাশিয়া থেকে শক্তিশালী নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন, তখন তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়াও, তিনি ইউক্রেনের সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ করে দেন। শুধু ইউক্রেন এই নয়, ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিও তিনি কঠোর নীতি গ্রহণ করেন। তিনি ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে মার্কিন বাজারে ইউরোপীয় রপ্তানির ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের হুমকি দেন। ট্রাম্প মনে করেন, এভাবে চাপ সৃষ্টি করলে ইউক্রেন ও তার মিত্রদের কোনো উপায় থাকবে না, তারা বাধ্য হয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটাবে এবং রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করতে সম্মত হবে । ট্রাম্পের এই পরিকল্পনার ফলে বিশ্বরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। প্রথমত, ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। যদি ট্রাম্প ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাশিয়ার সঙ্গে আপস করতে বাধ্য করেন, তাহলে সেটা ইউক্রেনের জন্য একটি বিশাল কূটনৈতিক পরাজয় হবে। দ্বিতীয়ত, এই পরিকল্পনা ইউরোপীয় মিত্রদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ইউরোপের দেশগুলো যদি বুঝতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে না, তাহলে তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা নীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হবে। ফ্রান্স ও জার্মানি ইতিমধ্যে নিজেদের প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করতে নতুন সামরিক পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, যা ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরো বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। তৃতীয়ত, যদি রাশিয়া ইউক্রেনে তার নিজস্ব চাওয়া অনুযায়ী চুক্তি করতে সফল হয়, তাহলে চীন একই রকম একটি পরিকল্পনা তাইওয়ানের ক্ষেত্রেও বাস্তবায়ন করতে পারে। তাছাড়াও ট্রাম্পের এই কৌশল যদি সফল হয়, তাহলে ন্যাটোর ঐক্য দুর্বল হয়ে পড়বে এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক দূরত্ব সৃষ্টি হবে ।
ভলোদিমির জেলেনস্কি সম্ভবত মনে করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র চিরকালই তাদের পাশে থাকবে। কিন্তু তিনি যে সম্ভাবনা একেবারেই বিবেচনায় নেননি, তা হলো ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন। জেলেনস্কির আরেকটি বড় কৌশলগত ভুল ছিল, তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রচারণায় সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। এই ভুলের কারণে ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাকে রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট নেতা হিসেবে দেখতে শুরু করেন। এমনকি ২৮ ফেব্রুয়ারি ওভাল অফিসের বৈঠকে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স সরাসরি জেলেনস্কির এই কৌশলগত ভুলের কথা উল্লেখ করেন এবং এটিকে তার ‘মারাত্মক ভুল' বলে অভিহিত করেন। জেলেনস্কি আশা করেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা কমিয়ে দেয়, তাহলে ইউরোপীয় মিত্ররা এই শূন্যতা পূরণ করবে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ জেলেনস্কির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেছে। তবে বাস্তবতা হলো, এই দেশগুলোর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত সামরিক সক্ষমতা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই । এছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে । অনেক ইউরোপীয় নাগরিক এই যুদ্ধের অর্থনৈতিক চাপ ও জ্বালানির ঘাটতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, ইউরোপে চরম ডানপন্থি ও কিছু বামপন্থি রাজনৈতিক দল ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তির পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে এবং এই ইস্যুটি তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে । এই কারণগুলো ট্রাম্পের কৌশল সফল হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলেছে । আরেকদিকে ট্রাম্পের পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, তিনি এই চুক্তির সিদ্ধান্ত থেকে ইউক্রেনের সরকার ও সাধারণ জনগণকে কার্যত বাদ দিতে চান । একটি শান্তিচুক্তি তখনই টেকসই হয়, যখন উভয় পক্ষ এটিকে ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য মনে করে । কিন্তু ট্রাম্পের পরিকল্পনা ইউক্রেনের জনগণের জন্য অপমানজনক ও একতরফা বলে মনে হচ্ছে। যদি তিনি প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে চাপে ফেলে এমন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করাতে বাধ্য করেন, যা ইউক্রেনের স্বার্থের পরিপন্থি, তাহলে ইউক্রেনের সাধারণ জনগণ এটি মেনে নেবে না। তারা এই শান্তি প্রক্রিয়াকে ‘জোরপূর্বক আত্মসমর্পণ’ হিসেবে দেখবে। ট্রাম্পের নীতির আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠবে। ডেমোক্রেটিক পার্টি ও ইউরোপীয় মিত্ররা ট্রাম্পের এই কৌশলকে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের পরিপন্থি ও ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করছে। এ কারণে ট্রাম্প তার পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করলেও, এটি দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ট্রাম্পের কৌশল ইউক্রেন ও তার মিত্রদের ওপর শক্তিশালী চাপ সৃষ্টি করতে পারলেও বিশ্বজনমতের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হতে পারে। যদি ইউক্রেনের জনগণ এই চুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে না করে, তাহলে এটি আরো বড় রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। যুদ্ধ হয়তো আপাতত থেমে যাবে, কিন্তু আবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে। বিশ্বরাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই যুদ্ধের সমাপ্তি যে সহজ হবে না, সেটি স্পষ্ট। তবে ট্রাম্পের কৌশল বাস্তবায়িত হলে ইউরোপের নিরাপত্তা ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। শান্তি অর্জন করা সব সময়ই একটি জটিল প্রক্রিয়া, তবে একটি টেকসই সমাধান খুঁজে না পাওয়া গেলে, এই যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হবে এবং এর প্রভাব গোটা বিশ্বের ওপর পড়বে। 

এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস