আন্তর্জাতিক

বাংলাদেশের পাশে ‘শিঙল্যাং ইসরাইল’ নামে নতুন ইহুদি রাষ্ট্রের পরিকল্পনা?

রেজিমেন্টেড ব্যবস্থা বা সরকারের ভিন্ন মতকে কট্টরভাবে নিয়ন্ত্রণের সাথে গণতান্ত্রিক চেতনার সম্পর্ক অনেকটাই বিপরীতমুখী। সাধারণত দেখা যায় গণতন্ত্রকে হত্যার চেষ্টাও গণতন্ত্রের নামেই করতে হয়। ধর্মের দূতদের নানা সময় হত্যা করা হয়েছে ধর্মের নামেই।
দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য যারা কাজ করেন তাদের মৃত্যু ঘটানো হয় দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে। আজ আমরা যে প্রবণতা দেশে- বিদেশে দেখতে পাচ্ছি তার দৃষ্টান্ত মানব ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বারবার দেখা গেছে।
পাঁচ হাজার বছর আগে ঐশী কিতাবভিত্তিক ধর্মের অগ্রজ নবী হজরত ইব্রাহিম আ:কে প্রজ্বলিত আগুনে ফেলে নমরুদের হত্যার প্রচেষ্টা, হজরত মুসা আ:কে হত্যার জন্য ফেরাউনের ধাওয়া করে লোহিত সাগর বক্ষে নিয়ে যাওয়া, হজরত ইসা আ:কে শূলে চড়িয়ে হত্যা বা হত্যার চেষ্টা আর হেমলক বিষ খাইয়ে গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মৃত্যু ঘটানো হয়েছিল। এসব হয়তো অনেক দিনের পুরনো ইতিহাস। কিন্তু পৃথিবীর দেশে দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে এখনো। এসব ঘটনা কোথাও ঘটানো হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহী, কোথাও সন্ত্রাসী, আবার কোথাও ধর্মীয় জঙ্গিবাদী লেবেল এঁটে দিয়ে। কারো ব্যাপারে ঘটনার রহস্য প্রকাশ হয়ে পড়ছে, কারো ক্ষেত্রে থাকছে একেবারে অজানা। এক সময় এসব ঘটনার উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়, কিন্তু তখন কিছুই আর করার থাকে না।

সমসাময়িক বাংলাদেশ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেসব সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ এখন ঘটছে তার অন্তরালে থাকছে অনেক অজানা পরিকল্পনা (পড়–ন ষড়যন্ত্র) সক্রিয়। কোথায়ও গণতন্ত্রের সৈনিকেরা পরিচিত হচ্ছে গণতন্ত্রের শত্রু হিসেবে। কোথায়ও জাতীয় মুক্তির জন্য লড়াই করে লেবেল মিলছে জাতীয় শত্রু হিসেবে। কোথাও ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লড়াই করে পরিচয় মিলছে ধর্মীয় শত্রুর। কোথাও গরিবের মুক্তির জন্য লড়াই করে সাম্রাজ্যলিপ্সুর এজেন্ট হিসেবে খ্যাত হচ্ছেন।সঙ্ঘাত কেন ছড়িয়ে পড়ছে?
দেশে দেশে সঙ্ঘাত কেন ছড়িয়ে পড়ছে এ প্রশ্ন আজ সর্বত্র আলোচিত। ইউক্রেন নিয়ে, মধ্যপ্রাচ্যে, মধ্য এশিয়ায়, দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে যে অস্থির পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে আমেরিকান ভিন্নমত প্রকাশকারী অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি ১০০ বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের লক্ষণ প্রত্যক্ষ করছেন। তার আশঙ্কা পরিস্থিতি যেভাবে সঙ্ঘাতমুখর হয়ে উঠছে তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা যেন অনিবার্য হয়ে উঠছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যে অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়েছিল সেখানেও শুরু হয়েছে নতুন অস্থিরতা। ক্রিমিয়া ছিল বিশ্ব সঙ্ঘাতের অন্যতম ক্ষেত্র। ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। আমেরিকা ন্যাটোর নেটওয়ার্ক রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে মনে করেছিল সাবেক সোভিয়েতভুক্ত স্বাধীন প্রজাতন্ত্রগুলোকে নিরাপত্তার জালে আবদ্ধ করবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চেয়েছিল পুরোপুরি ইউরোপীয় বলয়ের মধ্যে একাত্ম করে নিতে ইউক্রেনকে। এখানে রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগ বা অন্য কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়টা সেভাবে বিবেচনায় হয়তো আনতে চায়নি ইইউ।
ক্রিমিয়া দখল ও ইউক্রেনকে প্রভাব-কর্র্তৃত্বে এনে রাশিয়া বার্তা দিতে চেয়েছে দেশটি তার স্বার্থের ব্যাপারে কোনো আপস করবে না। এর আগে গ্যাস সম্পদের সুবাদে রাশিয়ার অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শক্তি অর্জন করে, যা দেশটির সামরিক সামর্থ্যকে পুনর্গঠনের সুযোগ এনে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন একই ধরনের শক্তি অর্জন করেছিল। যুদ্ধের আগে শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে অর্থনৈতিক শক্তি জোরালো করেছিল জার্মানি ও জাপান। এখন আমেরিকা ও সহযোগী পশ্চিমা দেশগুলোর বিপরীতে রাশিয়া-চীনের যে অর্থনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটছে তা নতুন অবয়বের স্নায়ুযুদ্ধকে যেমন অনিবার্য করে তুলছে তেমনিভাবে আরেক মহাযুদ্ধের আশঙ্কাকেও বাড়িয়ে তুলছে।
ক্রিমিয়া দখল এবং ইউক্রেন উত্তেজনায় রাশিয়া যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তাতে ইউরোপ আমেরিকার ঠাণ্ডা সাড়া হয়ে পড়ছে অনেকটা পরাভব মেনে নেয়ার মতো।
পূর্ব ইউক্রেনে রুশ ট্যাংক ও সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে ন্যাটোর দাবি পুতিন অস্বীকার করলেও সেখানে যেকোনো সময় ভয়ঙ্কর লড়াই শুরু হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে। এ লড়াইকে পাশ্চাত্য তাদের কর্র্তৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছে কিন্তু এর সামরিক জবাব দানের প্রস্তুতি ততটা ন্যাটোর দেখা যাচ্ছে না। এতে ক্রিমিয়ার মতো ইউক্রেনের একটি অংশ রাশিয়ার করতলগত হয়ে যেতে পারে। অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে স্বাধীন ইউক্রেনের ভবিষ্য। জর্জিয়াসহ ইউরোপের সাথে সম্পর্ক রক্ষাকারী আরো কয়েকটি প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যতও হয়ে উঠতে পারে অনিশ্চিত।
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের মধ্যে অনেকে হিটলার-মুসোলিনের প্রতিভূ দেখতে পান। রাশিয়ার অর্থনীতির তেজি অবস্থা ফিরে আসার পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার সাথে চীনের সাথে বিশেষ সম্পর্ক নির্মাণ পুতিনের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার লক্ষণ বলে অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা। এর বিপরীতে যুদ্ধবৈরী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা, ডেভিড ক্যামেরনের ব্রিটিশ নেতৃত্ব, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়াঁ ওঁলান্দের মধ্যে ততটা দৃঢ়তা নেই যে, পাশ্চাত্যের সার্বিক স্বার্থ রক্ষার জন্য তারা বড় রকমের ঝুঁকি নেবে।
এই নমনীয়তা অবশ্য পুতিনকেও নমনীয় করলে যুদ্ধের ঝুঁকি কিছুটা কমাতে পারে। আবার ঘটতে পারে এর উল্টোটাও। এ কারণে বলকান অঞ্চলের জটিল পরিস্থিতি বৈশ্বিক অচলাবস্থা নিয়ে আসতে পারে বলে মনে করছেন চমস্কির মতো আরো অনেকে।
মধ্যপ্রাচ্যের অগ্নিস্ফুলিঙ্গমধ্যপ্রাচ্যে আজ যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে বড় ধরনের আঞ্চলিক মহাযুদ্ধ বেধে যেতে পারে। এখানকার আরব জাগরণ, ইসলামিস্টদের নিশ্চিহ্ন করার কর্মসূচি, ফিলিস্তিনে অচলাবস্থা, সিরিয়ায় নারকীয় পরিস্থিতি, আইসিসের খেলাফত রাষ্ট্র, কুর্দি সঙ্কট, শিয়া-সুন্নি সঙ্ঘাত, ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণে প্রভাব বিস্তার সবকিছু একটি বড় আকারের যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে মধ্যপ্রাচ্যে। এই যুদ্ধ যদি আইসিসের খেলাফত রাষ্ট্র ধ্বংস করার জন্য শুরু করা হয় তা হলেও যুদ্ধান্মাদনা কেবল এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে সীমিত থাকবে না।
মিসরে জেনারেল সিসি তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে লিবিয়ার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা চান। অনিশ্চয়তা ছড়াতে চান সুদান ও ইথিওপিয়ায়ও। সোমালিয়া আগে থেকেই রয়েছে প্রজ্বলমান। মিসরের উচ্চাভিলাষ কোয়ালিশনে রয়েছে কয়েকটি প্রভাবশালী আরব দেশের নেপথ্য ইন্ধন। ইসরাইল চাইছে শিয়া-সুন্নি স্নায়ু লড়াই, একনায়কতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্ঘাত, হামাস-ফাতাহ বিভাজন টিকিয়ে রাখতে। এমন অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যে তৈরি করতে যাতে আরব রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা তাদের নিরাপত্তার জন্য তেলআবিবের কাছে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ধরনা দেয়। ইসরাইল পরিণত হয় জঙ্গলের মারামারি-কাটাকাটির মধ্যে শান্তির প্রাসাদ।বিশ্বশক্তি, আঞ্চলিক শক্তি ও ইসরাইলের এসব হিসাব-নিকাশ ও পরিকল্পনা অনুসারে সবকিছু ঘটতে থাকবে এমনটি নাও হতে পারে। সৃষ্ট পরিস্থিতি বুমেরাং হয়ে উল্টো বিনাশ করতে পারে পরিকল্পনাকারীদেরও। এ কারণে পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত আরব হয়ে উঠতে পারে আরেকটি মহাযুদ্ধের কেন্দ্রস্থল।
মধ্য এশিয়ার সঙ্ঘাতজ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের মহাখেলার একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল আফগানিস্তান ও সন্নিহিত মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলো। দক্ষিণ এশিয়ার সন্ধিস্থলে অবস্থানের কারণে আফগানিস্তান পরিণত হয় আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের প্রধান নিশানা। এর অংশ হিসেবে দেশটিতে একসময় বসানো হয় সোভিয়েত পুতুল সরকার। আফগান প্রতিরোধ যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে সোভিয়েত সৈন্যরা বিদায় নেয় আফগানিস্তান থেকে। এখানকার বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক চাপ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার বড় কারণে পরিণত হয়।
পরে আফগানিস্তানে প্রতিরোধ গ্রুপগুলোর দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের পথ ধরে কট্টরধারার তালেবান ক্ষমতা দখল করে। আলকায়েদার সাথে তালেবান সম্পর্কের জের ধরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় দেশটিতে। গণতন্ত্র ও সেকুলার ভাবধারা প্রতিষ্ঠার পাশ্চাত্যের প্রচেষ্টা আফগানিস্তানে সফল হয়নি। জঙ্গি দমনে কঠোর পদক্ষেপ তালেবান প্রভাব প্রতিপত্তিকে আরো বাড়িয়েছে। ২০১৪ সালে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে তার সৈন্য প্রত্যাহার করার কথা। কিন্তু সেখানে এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি টেকসই এমন কোনো ব্যবস্থা যাতে পাশ্চাত্য এই ভূখণ্ডের বিষয়ে তাদের স্বার্থরক্ষা নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই প্রধান প্রার্থী আশরাফ গনি ও আবদুল্লাহ সেখানে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতার ভাগাভাগি করেছেন। এটি স্থিতি আনতে কিছুটা সহায়ক হবে। কিন্তু বৃহত্তর শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তালেবানদের অন্তর্ভুক্ত করা না হলে সাফল্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে সুদূর পরাহত।
আফগানিস্তান-পাকিস্তানকে ভেঙে কয়েক টুকরো করার পরিকল্পনার বিষয় বেশ ক’বছর আগেই মার্কিন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছে। এখন এ অঞ্চলে যে সঙ্ঘাত ও বহুমাত্রিক রক্তক্ষয় চলছে তার পেছনে এ ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। তবে এর পরিণতি যে একটি ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে সে আশঙ্কা রয়ে গেছে। এ ধরনের পরিকল্পনায় ভারত যুক্ত হলে দক্ষিণ এশিয়ার এই বৃহৎ দেশটির অখণ্ডতার জন্য হতে পারে তা উদ্বেগজনক।
অস্থিরতার নতুন কেন্দ্র বাংলাদেশ!বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় অস্থিরতার এক নতুন কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। এই অঞ্চলকে অস্থির করার খেলা শুরু হয় বেশ ক’বছর আগে থেকেই। ২০০৭ সালে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত করে সামরিক সমর্থনপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সরকারের নানা ধরনের বিতর্কিত পদক্ষেপ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও ধারাবাহিক স্থিতিকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দেয়। এ সময় দুর্নীতিবাজ ধরার নামে দেশের শীর্ষস্থানীয় উদ্যোক্তাদের এমনভাবে হয়রানি করা হয় যে, এর পরের বিনিয়োগ স্থবিরতা আর ফিরিয়ে আনা যায়নি। অনেক শিল্পোদ্যোক্তা শিল্প স্থাপনের জন্য চীন, ভিয়েতনামসহ অন্য স্থিতিশীল দেশ বেছে নেয়। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদায় গ্রহণ করার নির্বাচনের যেসব রহস্য এখন বের হচ্ছে তাতে বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
তত্ত্বাবধায়ক-উত্তর আওয়ামী লীগ সরকার সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ নিয়ে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা পরিচালনা করছে।সাধারণভাবে রক্ষক্ষয়ী বিপ্লব বা মুক্তিযুদ্ধের পর যে ধরনের বৈপ্লবিক বা প্রতিশোধপরায়ণতা বিশ্বের কোনো কোনো দেশে দেখা গেছে তার পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যায় গত ছয় বছর সময়ে। এ সময়ে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিকল্পনা বা কর্মসূচি প্রকৃতপক্ষে কতটা সক্রিয় আর কতটা এ ধরনের এক শাসন কায়েমের এজেন্ডা পালনে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে তা এক সময় হয়তো প্রকাশ হবে। কিন্তু ভেতরের খবরাখবর যারা বিশ্লেষণ করেন তাদের অনেকের বক্তব্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সরকারের সব কার্যক্রম নিজের ইচ্ছায় করতে পারছেন না। কিছু এজেন্ডা বাস্তবায়নের শর্ত মেনে তাকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছিল। তাকে ক্ষমতায় থাকার জন্য সেসব এজেন্ডা কার্যকর করতে হচ্ছে। আর এর বাইরে যাওয়া তার জন্য সম্ভব হবে না। যখন যাবেন তখন তিনি আর ক্ষমতায় থাকবেন না।
বাংলাদেশের ঘটনা পরম্পরাকে যারা গভীর থেকে বিশ্লেষণ করেন তাদের সামনে বিশেষ কিছু বিষয় স্পষ্টভাবে সামনে চলে আসে। বাংলাদেশে প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তি ও বিশ্বশক্তিগুলো এ দেশে সামাজিকভাবে শক্ত বিভাজন প্রত্যাশা করেছে নিজ নিজ স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে। যে বিভাজন রাষ্ট্রের মধ্যে এক দিকে পরস্পর বৈরিতাকে দীর্ঘস্থায়ী করবে, অন্য দিকে শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতাকে ক্ষুণ করবে। কার্যত এ সময়ে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন রাষ্ট্রকে স্পষ্ট দু’টি শিবিরে বিভক্ত করার মাধ্যমে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে দেশের রাজনৈতিক শক্তি কোনো বড় রকমের জাতীয় ইস্যুতেও আর এক হতে না পারে।অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন এর পেছনে একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এবং তার পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের একটি শক্তিমান ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা সক্রিয় ছিল। অবশ্য দুই রাষ্ট্রের কাজ অভিন্ন হলেও তাদের লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। প্রতিবেশী দেশটি মনে করেছে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী ইসলামিস্ট ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ক্রাস করা গেলে এ দেশের রাজনীতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দীর্ঘস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশটির লক্ষ্য ছিল অনেক গভীর। তাদের লক্ষ্য হলো এ অঞ্চলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করা। এ জন্য এ অঞ্চলের তিন দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও
মিয়ানমারের প্রতি তাদের দৃষ্টি অনেক দিনের।শত শত বছর ধরে এখানকার উপজাতীয় অঞ্চলগুলোতে ধর্মান্তরের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসা হয়েছে। খ্রিষ্টান মিশনারি তৎপরতায় ভারতের সাত রাজ্যের বেশির ভাগ রাজ্যে অহিন্দুরা সম্মিলিতভাবে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। কয়েকটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেছে খ্রিষ্টানরা। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মিয়ানমারের শিন রাজ্যেও একই ধরনের মিশনারি তৎপরতা পরিচালিত হয়।
এর মধ্যে ভারতের মিজোরোম ও মনিপুরে কয়েকটি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবিষ্কার করা হয় ইহুদিদের হারানো ১০ গোত্রের মধ্যে একটি গোত্র। যাদেরকে বলা হচ্ছে যুশেফের (হজরত ইউসুফ আ:) সন্তান মেনাসের বংশধর। তাদের আচার ও জীবনাচরণ ও ধর্মচর্চায় প্রভাব আবিষ্কার করা হয় জুদাইজমের। হারানো ১০ ইহুদি গোত্রের অন্য কয়েকটি ভারতের অন্য অঞ্চলে বসতি করে বলে উল্লেখ করা হয়।
গত দশকে ইসরাইলের শীর্ষ ইহুদি রাব্বি (যাজক) শ্লোমো আমরের রুলিংয়ের ওপর ভিত্তি করে মনিপুর-মিজোরামের ৯ হাজার লোককে ইহুদি হিসেবে ইসরাইলে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। রাব্বি শ্লোমো তাদের হারিয়ে যাওয়া ইহুদি গোত্রের বংশধর হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও শত শত বছর ধরে ইহুদি ধর্মাচার থেকে দূরে থাকার কারণে তাদের ইহুদি ধর্মমতে ফেরানোর জন্য আলিয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বলেন। এভাবে নানা টানাপড়েনের মধ্যেও মনিপুর-মিজোরাম থেকে কথিত ইহুদিরা ইসরাইলে পুনর্বাসন গ্রহণ করেন এবং তাদের বিতর্কিত ফিলিস্তিন অঞ্চলগুলোতে বসতির ব্যবস্থা করা হয়।
এর মধ্যে ইহুদি রাব্বিরা ইসরাইলে ইহুদি ধর্মমতে ফেরানোর অনুষ্ঠানের পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে এসেও মনিপুর-মিজোরোমের কুকি মিজু ও শিনদের ইহুদি ধর্মমতে ফেরানোর কাজ করেন। এ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে এখন ইহুদি ধর্মমতে ফেরানোর এই কার্যাদি নেপালে নিয়ে গিয়ে সম্পন্ন করা হচ্ছে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের কথিত হারানো গোত্রের ইহুদিদের ইসরাইলে নিয়ে যাওয়াতে বড় রকমের বিপত্তি না ঘটলেও ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানদের ইহুদি ধর্মমতে ফিরিয়ে আনা আর তাদের রাজনৈতিক অধিকারের দাবি ওঠানোর পর ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। মিজোরামে ইহুদি সংখ্যা অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ায় এর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের আশঙ্কা চেপে বসে।
মিজোরামের রাজধানী আইজল খ্রিষ্টান গবেষণা কেন্দ্রের ড. বিয়াকশিয়ামা বলেন,‘বিদেশী রাব্বি এসে ব্যাপকভাবে ইহুদি ধর্মান্তরে এই এলাকায় শুধু সামাজিক অস্থিরতাই সৃষ্টি হচ্ছে না একই সাথে তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক মানুষ অন্য দেশের নাগরিকত্ব লাভের উপযুক্ত হচ্ছে যাতে ভারতের প্রতি তাদের আনুগত্য হয়ে পড়ছে প্রশ্নসাপেক্ষ।’এটি আরো বেশি আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয় যখন ড. বিয়াকশিয়ামা ২০০৪ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন শিঙল্যাং ইসরাইল পিপলস কনভেনশনের (সিআইপিসি) প্রতিষ্ঠাতা লালশানিমা সাইলোর একটি বক্তব্য তুলে ধরেন। এই বক্তব্যে সাইলো বলেন, ‘সিআইপিসির লক্ষ এখানকার ইহুদিদের ইসরাইলে পুনর্বাসনের জন্য পাঠানো নয়, তবে জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে এই এলাকাকে মিজো উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করার ব্যবস্থা আমরা করতে চাই, যা এখানে মিজো ইসরাইলিদের একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনে সাহায্য করবে।’ এর পর থেকে মিজোরাম বা মনিপুর থেকে ইসরাইলে পুনর্বাসন অনেকটাই কমে যায় কিন্তু ইহুদি ধর্মমতে পাহাড়িদের প্রত্যাবাসন চলছে অব্যাহতভাবে।
১৮৯৪ সালে খ্রিষ্টান মিশনারির কাজ শুরু করার পর বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে মিজোরামে বেশির ভাগ পাহাড়ি খ্রিষ্টান হয়ে যায়। একই সময়ে মনিপুরে খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী পৌঁছে যায় ৩০ শতাংশে। ১৯৫১ সালে একজন পাহাড়ি নেতা ইসরাইলে গিয়ে জুদাইজমে দীক্ষা নিয়ে তা অনুসরণ করেন এবং সেখান থেকে দেশে ফিরে এসে মিজোদের ইহুদি সম্পৃক্ততার বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালান। এর পর থেকে মিজোরাম মনিপুরে কথিত ইহুদি ধর্মমতে প্রত্যাবাসন বাড়তে থাকে। এতে বর্তমানে মিজোরামে ইহুদি সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশ আর খ্রিষ্টান সংখ্যা অনেক কমে ৪০ ভাগে নেমে এসেছে। এর আগে খ্রিষ্ট ধর্মমত গ্রহণকারী মিজো কুকি শিনরা প্রধানত ইহুদি ধর্মমতে চলে আসায় ইহুদিসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কমছে খ্রিষ্টানসংখ্যা।এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অচিরেই রাজ্যটিতে ইহুদিসংখ্যা খ্রিষ্টানদের ছাড়িয়ে যাবে। হিন্দু ধর্মমতের মতো ইহুদি ধর্মমত গ্রহণ করা যায় না বলে মিজো-কুকিদের পুরনো ইহুদি বলে স্বীকৃতি দিয়ে জুদাইজমে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
মিজোরামে ‘শিঙল্যাং ইসরাইল’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গোপন সমঝোতার কথা জানা যায়। এই সমঝোতা অনুসারে মিজোরামে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সহযোগিতার বিনিময়ে ইহুদিরা পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবে।
শিন-কুকি-মিজো উপজাতীয় যাদেরকে ইহুদিদের হারানো গোত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে তাদের বসবাস মিজোরাম মনিপুরের বাইরে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মিয়ানমারের শিন রাজ্যেও রয়েছে। এ ব্যাপারে ইহুদিদের বিভিন্ন গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে শিন-কুকি-মিজো এবং অন্য পাহাড়িদের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ লাখ জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা এক সময়ের হারানো ইহুদি গোত্রের বংশধর। এই সংখ্যক জনগোষ্ঠী একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পর্যাপ্ত মনে করা হয়। এ লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করা গেলে ইসরাইলে যে এক লাখের কাছাকাছি ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইহুদি রয়েছে তাদের প্রয়োজনে ফিরিয়ে আনা হতে পারে।প্রশ্ন উঠতে পারে মিজোরাম বা মনিপুরে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের শিন-রাখাইন রাজ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির কি সম্পর্ক থাকতে পারে? বিশ্ব রাজনীতির নিয়ম অনুসারে কোনো অঞ্চলে নতুন কোনো বিন্যাস ঘটাতে হলে সেখানে নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে হয়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার সাথে এর যোগসূত্র রয়েছে। এ অঞ্চলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে এর সামনে সম্ভাব্য প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ইসলামিস্টরা। এই কাজ বিএনপিকে দিয়ে করানো সম্ভব হবে না বিধায় ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে বিএনপির কোমর ভাঙা হয়। এরপর এমন এক সাজানো নির্বাচন করা হয় যাতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে মহাজোটের সরকার। সে সরকারকে দিয়ে যুদ্ধাপরাধ বিচার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা, নির্যাতন ও দমনের মাধ্যমে দেশে চরম সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়।এই কার্যক্রম শেষ মনে করা হলে আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকার আর ক্ষমতায় নাও থাকতে পারে। নেপথ্যে থেকে যে শক্তি একটি আল্ট্রা সেকুলার ফোর্সকে দিয়ে ইসলামিস্টদের দমনের চেষ্টা করেছে সেই শক্তি এক সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ভারতবান্ধব সরকারকে ক্ষমতায় আর নাও চাইতে পারে। সেটি হতে পারে বর্তমান সরকারের অকাল পতনের একটি কারণও। কিভাবে কখন সেটি ঘটতে পারে তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও নানা ঘটনার অন্তর্নিহিত বার্তা থেকে এটি খুব বেশি দূরে নয় বলেই মনে হয়। জঙ্গি জিগির তুলে এখানে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়ার পেছনে এই শক্তির পরিকল্পিত পরামর্শও থাকতে পারে। আর এসব কারণে বাংলাদেশে আগামী দিনগুলোতে স্থিতিশীলতা কতটা শেষ পর্যন্ত ফিরে আসে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। বাংলাদেশে গত ৭-৮ বছর আন্তর্র্জাতিক ও আঞ্চলিক দুই প্রভাবশালী শক্তি এক হয়ে কাজ করেছে। সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলো দেখে মনে হয় এখন এই দুই শক্তির পথযাত্রা ও কৌশল বেশ খানিকটা ভিন্নমুখী হতে শুরু করেছে। এর প্রভাব আগামী বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে পড়বে অনিবার্যভাবেই। অন্য দিগন্ত