আন্তর্জাতিক

পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত জঙ্গি হাম্বালিকে শাস্তি দিতে চলেছে আমেরিকা

পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত জঙ্গি রিদুয়ান ইসামুদ্দিন, ওরফে হাম্বালি ও তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছে আমেরিকা। ২০০২ সালে বালিতে ২০২ জন সাধারণ নাগরিককে হত্যায় অভিযুক্ত হাম্বালি। ২০০৩ সালে জাকার্তা বিস্ফোরণেও মূল অভিযুক্ত সে। জেমা ইসলামিয়া (জেআই) জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রধান কৌশলবিদ হাম্বালিকে বলা হয় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ওসামা বিন লাদেন। তারই নেতৃত্বে আল-কায়দা ও জেআই ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিনস, সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া ও কম্বোডিয়ায় একাধিক জঙ্গি আক্রমণ চালিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ২০০৩ সালে এই কট্টর জঙ্গি থাইল্যান্ডের আয়ুথায়া থেকে গ্রেফতার হয়। উঠে আসে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী কাজকর্মে মদতের আরও একটি অকাট্য প্রমাণ। তবে বিচার চলাকালেই তার দুই ঘণীষ্ট সহযোগীকে ইন্দোনেশিয়ার মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

আবদুল্লাহ সুংকার ও আবু বকর বাসিরের মৌলবাদী প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে জিহাদের জগতে প্রবেশ হাম্বালির। ১৯৮০ সালে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য তাকে আফগানিস্তানে পাঠানো হয়। পেশোয়ারের একটি প্রশিক্ষণ শিবিরেই পাক-গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের নজরে আসে সে। আইএসআই বুঝে যায়, হাম্বালিকে দিয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সন্ত্রাসের জাল বিস্তৃত করতে সুবিধা হবে। ১৯৮৭ সালে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে আফগানিস্তানের জাজি যুদ্ধে অংশ নেয় হাম্বালি। জিহাদ সম্পর্কেও সেই থেকেই একটা স্বচ্ছ ধারণা পেতে থাকে গোটা দুনিয়া।

জঙ্গি কার্যকলাপ বৃদ্ধি করার জন্য হাম্বালি ১৯৯০-এ মালেশিয়া থেকে ফিলিপিনস, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি সফর করে। বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে নিজেদের জাল বিস্তারে সক্ষমও হয়। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের প্রতিবেদনেও উঠে আসে হাম্বালির কাজকর্মের বিবরণ। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের জয়েন্ট টাস্ক ফোর্স গুয়ানতানামোর ডিটেনশন ক্যাম্পের ২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবরের রিপোর্ট বলছে, '১৯৯৭-এর মাঝামাঝি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সোলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)-র সঙ্গে বৈঠক করতে পাঠানো হয়েছিল হাম্বালিকে।' পাক-গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর এক অফিসার ব্যাংকক-এ বসেই এই বৈঠকের বন্দোবস্ত করেন। আইএসআইয়ের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের যোগাযোগ অবশ্য আগে থেকেই। রোহিঙ্গাদের কাঁধে বন্দুক রেখে বহুদিন ধরেই পাকিস্তান এই অঞ্চলকে অস্থির করে তোলার চেষ্টা করছে।

ইন্দোনেশিয়ায় ফিলিপিনসের রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে এবং চার্চে বিস্ফোরণের হাত ধরে মুসলিম জিহাদে আত্মপ্রকাশ হাম্বালির। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-এর তথ্য বলছে, এই দুই আক্রমণের পরই হাম্বালি পালিয়ে যায় মালেশিয়া। সেখানে থেকে পাকিস্তানের করাচিতে। পাকিস্তানে থাকার সময়ই সে নয়-এগারোর মূলচক্রী খালিদ শেখ মোহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করে করাচিতে জেআই জঙ্গিদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। আল-কায়দার শিবিরেও তাদের প্রশিক্ষণ হয়। বাড়তে থাকে হাম্বালির গুরুত্ব। জঙ্গি নেতাদের আস্থা অর্জন করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাকে। এক সময়ে হাম্বলির হাতেই ছিল আল-কায়দার বিভিন্ন কর্মসূচি রূপায়নের দায়িত্বও। কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেনে ব্রিটিশ ও মার্কিন দূতাবাসে আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল তার। জাকার্তায় হেলিকপ্টারের মাধ্যমে মার্কিন দূতাবাসে হামলারও ষড়যন্ত্র সে করেছিল। চেষ্টা করেছিল ভূমি থেকে ভূমি ক্ষেপনাস্ত্র কেনারও। আল-কায়দার হয়ে কম্বোডিয়ায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মূল নেতাই হয়ে উঠেছিল হাম্বালি। শুধু কম্বোডিয়াই নয়, আল-কায়দার আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা লাভ ও সমন্বয়েও মুখ্য ভূমিকায় ছিল সে। ইউএসএস কোল বিস্ফোরণের পান্ডা তৌফিক বিন আতাশ ও জাকারিয়াস মৌসৌই এবং নয়-এগারোর নওয়াজ আল হাজমি ও খালিদ আল মিলদারের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থারও দায়িত্বে ছিল হাম্বালি। পাকিস্তান তাকে জাকার্তায় জে ডব্লিউ মেরিয়ট হোটেল ও অস্ট্রেলিয় দূতাবাসে হামলার জন্য ১ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের তহবিল দেয়। ব্যাংকক থেকে সেই বিপুল পরিমান অর্থ অস্ট্রেলিয়ান ডলার ও মালেশিয়ান রিঙ্গিতে বদলানো হয়। পুরোটাই ছিল হাম্বালির ছক। এমনকী, মালাক্কার ক্যালটেক্স তেল শোধনাগারেও হামলার ছক ছিল তার। বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ আজাহারী বিন হুসিন রহকে নিয়োগ করা হয়েছিল।

২০০৩ সালে গ্রেফতারের সময় হাম্বালি এশিয়া স্পেসিফিক ইকনোমিক কনফারেন্স (এপিইসি) -এ আক্রমণের ছক কষছিল। এই কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। মালেশিয়ার জুবেইর মহম্মদকে গ্রেপ্তার করেই তার হদিশ মেলে। জুবেইর জেআই-এর আর্থিক লেনদেন নিয়ে কাজ করতো। হাম্বলি থাইল্যান্ডে আসে জাল স্পানিশ পাশপোর্ট নিয়ে লাওস হয়ে। ব্যাঙ্ককে পাকিস্তানি ডিফেন্স অ্যাটাচেই সব বন্দোবস্ত করে দেয়। পকিস্তানিরা অবশ্য বহুদিন ধরেই জাল পাসপোর্ট ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এর আগে, ব্যাঙ্ককে ২ জন ও বার্সিলোনায় ৭ পাকিস্তানি জাল পাসপোর্টের কারবার করতে গিয়ে ধরা পড়ে।

গ্রেফতারের ১৮ বছর পর হাম্বালি আজ বিচারের মুখে দাঁড়িয়ে। এমন সময়ে ইন্দোনেশিয়া হাম্বালির গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীদের ছেড়ে দিচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া ঠিক করেছে হাম্বালির ঘণীষ্ট সহযোগী উমর পাটেককে ছেড়ে দেবে। এমনকী, হাম্বালির সন্ত্রাসী গুরু আবু বকর বাসিরকেও ফের মৌলবাদী প্রচারের জন্য ছাড়া হচ্ছে। ২০১৯ সালেই উমর পাটেকের স্ত্রীকে নাগরিকত্ব দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। হাম্বালির স্ত্রী নরাইজে অবশ্য বহু দিন ধরেই নিখোঁজ। তবে অনেকেরই অনুমান সেও ইন্দোনেশিয়াতেই আশ্রিত। হাম্বালির আত্মীয়স্বজেনরাও অনেকেই রয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়। ফলে হাম্বালির সহযোগীদের মুক্তি নতুন করে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বাড়াতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। জিহাদের নামে মানব সভ্যতার সামনে ফের কোনো বড় বিপদ ডেকে আনে কিনা সেটাই দেখার। আমেরিকা অবশ্য হাম্বালির বিচারপর্বে ঢিলেমি দিতে নারাজ। বহু জঙ্গি হামলার কূখ্যাত নায়ক হাম্বালির বিচারপর্ব চলাকালেই তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তে ইন্দোনেশিয়াও এখন সন্দেহের তালিকায়। আর পাকিস্তানের জঙ্গি অর্থায়ন প্রমাণিত সত্য। হাম্বালি বা তার সহযোগিদের অপরাধ প্রবণতা কিন্তু খতম হবার নয়। এই সন্ত্রাসীরা ছাড়া পেলেই ফের বাড়বে সন্ত্রাসে মদত। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তারা ফের বিস্তার করবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের জাল।