দেশে বর্তমানে ডেঙ্গু ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীদের দ্রুত প্লাটিলেট ও প্রেসার কমে যাচ্ছে। প্রস্রাব কম হচ্ছে। বমি, মল কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রচণ্ড পেটব্যথা ও অনবরত বমি হওয়া; নাক ও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ ও অবসাদ। কখনো মস্তিষ্কের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পেট ও ফুসফুসে পানি জমে যাচ্ছে। অর্থাৎ এবার ডেঙ্গু রোগী দ্রুত সংকটাপন্ন অবস্থায় যাচ্ছে। কোন কিছু বোঝার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার মাত্র তিন দিনের মাথায় গতকাল সকালে মারা গেছেন অগ্রণী স্কুল এন্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী অনন্তি রায় (১১)। তিন দিন আগে জ্বর হলে পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থও ছিলেন। হঠাৎ করে বাবা-মায়ের চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন অনন্তি। চিকিৎসা প্রোটোকল পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের জটিলতা দেখা দিলে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ‘ডেক্সা ম্যাথাসন’ ইনজেকশন শিরায় ব্যবহার করতে হবে। এতে রোগীদের মৃত্যু ঝুঁকি কমে আসবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ওষুধ ব্যবহার নিয়ে চিকিত্সদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। বিতর্কের চেয়ে রোগীর জীবন বাঁচাতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক ওষুধেরই রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। এ নিয়ে তেমন কোন জটিল সমস্যা হয় না। মনে রাখতে হবে যে, মানুষের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। একটু সচেতনতার অভাবে একজন রোগীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে পারে।
রাজধানীর ড. আনোয়ার খান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় অনন্তি রায়ের। তার গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জে। আজিমপুর সরকারি কলোনির ১৮ নম্বর ভবনে পিতা-মাতার সঙ্গে থাকতেন অনন্তি রায়। সকালে হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ পৌরসভা এলাকা নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার সত্কার করা হয়েছে। অনন্তি রায়ের বাবা আকুল কুমার রায় জরিপ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা। তার দুই মেয়ের মধ্যে অনন্তি রায় বড়। ছোট মেয়ের বয়স ৫ বছর। অনন্তি রায়ের প্রথমে সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে (সাবেক রেলওয়ে হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থা খারাপের দিকে যায়। প্লাটিলেট কমতে কমতে ২৯ হাজারে নেমে আসে। জ্বরও কমছিল না। চিকিৎসকরা আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দেন। তারপর ড. আনোয়ার খান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। বুধবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখায় হয়। বৃহস্পতিবার সকালে মৃত্যু হয়।
অনন্তি রায়ের বাবা আকুল কুমার রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ডেঙ্গু কেড়ে নিলো আমার কলিজার টুকরাকে। কোন কিছু বোঝার আগেই বাবা-মায়ের চোখের সামনে এভাবে সন্তানের মৃত্যু- কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। পিতা-মাতার কোলে সন্তানের লাশ যে কত ভারি তা বলে বোঝানো যাবে না। অনন্তি রায়ের মৃত্যুতে অগ্রণী স্কুল এন্ড কলেজে শোকের ছায়া নেমে আসে। সহপাঠীরা ছুটে যান তাকে দেখতে। মেধাবি ছাত্রী হওয়ায় স্কুলে তার অনেক সুনাম ছিল। অগ্রণী স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষকরা বলেন, এভাবে একটা মেধাবি শিক্ষার্থীর জীবন চলে যাবে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সরা বলেন, ডেঙ্গুর মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকলেও মশা মারার কোন কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এটা খুবই লজ্জাজনক। ডেঙ্গু রোগীদের স্যালাইনের প্রয়োজন হয়। সেই স্যালাইনেরও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। ১০০ টাকার স্যালাইন এখন প্রতি স্যালাইন নিম্নে ৪০০ থেকে, আরো উপরের টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ এখানেও সিন্ডিকেট। মশা মারতেও ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এখন এডিস মশা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ডেঙ্গু হচ্ছে। মশা মারা ও সচেতনতার জন্য বড় ধরনের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এমিরেটস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, যখন ডেঙ্গু রোগীর শারীরিক অবস্থা জটিল হয়, তখন তার জীবন রক্ষা করা জন্য স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। দিনে ২/৩ বার স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ‘ডেক্সাম্যাথাসন’ ইনজেকশন রোগী শিরায় পুশ করলে রোগী দ্রুত ভালো হয়ে যায়। তিনি অনেক জটিল রোগীকে এই ইনজেকশন প্রয়োগ করেছেন। সেসব রোগী সুস্থ হয়ে গেছেন এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। তিনি বলেন, প্রায় ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তবে রোগীর জীবন বাঁচানোকে প্রথমে গুরুত্ব দিতে হবে। জটিল ডেঙ্গু রোগীদের স্টেরয়েড জাতীয় ইনজেকশন প্রয়োগের পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে দেশে গত একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরো ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে; একদিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৩২৭ নতুন রোগী। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মোট সংখ্যা পৌঁছাল ১১৩৫ জনে। আর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মোট সংখ্যা বেড়ে হল ২ লাখ ৩৩ হাজার ৫৩১ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত একদিনে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ঢাকায় ৬ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৭ জন মারা গেছেন। আর এ বছর যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৭০৯ জন ঢাকায় এবং ৪২৬ জন ঢাকার বাইরে। নতুন ভর্তি রোগীদের মধ্যে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৮৩৬ জন এবং ঢাকায় ৪৯১ জন। বাংলাদেশে এ বছর যত রোগী ভর্তি হয়েছে, তাদের মধ্যে ঢাকায় ৯০ হাজার ৫৩০ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ১ লাখ ৪৩ হাজার ১ জন। বর্তমানে সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ৬১৭ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ২৬৩৮ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৫৯৭৯ জন।
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস