গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শেয়ারবাজারে সুবাতাস ফেরার প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। দীর্ঘ সাত মাসেও প্রত্যাশা পূরণ দূরের কথা, উল্টো দর পতনসহ নানা সমস্যার কারণে হতাশায় নিমজ্জিত সবাই। এ অবস্থা থেকে বের করে আনার অন্যতম দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের। অথচ চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের সঙ্গে অধস্তন কর্মকর্তাদের টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেই সংকটের মধ্যে ফেলেছে।
নানাবিধ ইস্যুতে ক্ষোভের কারণে গত ৫ মার্চ নজিরবিহীন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের টানা চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন বিএসইসির কর্মকর্তারা। কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা এখনও অধস্তন কর্মকর্তাদের আস্থায় আনতে পারেননি। অতি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ডাকছে না কমিশন। নিজেদের অপরাধ ঢাকতে সিসিটিভি বন্ধ রাখাসহ আগের রেকর্ড মুছে ফেলার পর ফাইলপত্রও সরিয়ে নিতে পারেন কর্মকর্তারা– সাংবাদিকদের কাছে এমন শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদ।
অন্যদিকে, ৫ মার্চ অবরুদ্ধ করার ঘটনায় ১৬ জনের নাম উল্লেখসহ আরও অনেক কর্মকর্তা জড়িত থাকতে পারেন উল্লেখ করে মামলা দায়ের এবং কর্মকর্তাদের পুরো দায় দিয়ে মন্ত্রণালয়ে কমিশনের চিঠি পাঠানোতে অনেকে উদ্বিগ্ন। আবার নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর আরও কয়েকজনের বিষয়ে একই রকম পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে তাদের। এরই মধ্যে প্রেষণে কর্মকর্তা চেয়ে অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর পর চাপা ক্ষোভ আরও বেড়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, তারা স্বাভাবিক কাজে ফিরতে চাইছেন; কিন্তু কমিশনের দিক থেকে আন্তরিকতা দেখছেন না। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন কর্মকর্তারা। যদিও মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে এখনও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। এদিকে, গত সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে বিএসইসিকে আরও শক্তিশালী করা ও পুঁজিবাজার উন্নয়নে চার সদস্যের একটি কমিটি করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. এম সাদিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, কমিটি দীর্ঘমেয়াদি বিষয় নিয়ে কাজ করবে। তবে এখন যে অবস্থা চলছে, তা অস্বাভাবিক। এর দ্রুত অবসান হওয়া দরকার। সার্বিক বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী সমকালকে বলেন, এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা চলতে পারে না। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে দায়িত্ব বেশি কমিশনের, কারণ তারাই অভিভাবক। প্রেষণে সরকারি কর্মকর্তা এনে বিএসইসি চলবে না– মত দিয়ে সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, বিএসইসি স্বতন্ত্র ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এখানকার ‘টেকনিক্যাল’ কাজ সরকারের কর্মকর্তাদের দিয়ে হবে না। এটি করাও ঠিক হবে না। বিএসইসির পরিস্থিতি গত কয়েক দিন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিএসইসি কার্যালয়ে নানা পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রুটিন কিছু কাজ চললেও কমিশনের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের সঙ্গে অধস্তন কর্মকর্তাদের অনাস্থা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ আগের মতোই। কর্মকর্তারা ভয়ে আছেন, অবরুদ্ধ করার ঘটনার জেরে কখন কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয় কমিশন। এ অবস্থার মধ্যেই বিএসইসির পক্ষ থেকে প্রেষণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি দিয়েছে কমিশন। চিঠির বিষয় বিএসইসির প্রশাসন বিভাগ জানে না। এর আগে ৫ মার্চের ঘটনায় কর্মকর্তাদের দায়ী করে বিস্তারিত জানিয়ে আরও একটি চিঠি কমিশন পাঠিয়েছিল। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক সমকালকে জানান, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিএসইসির চিঠিটি পাঠানো হয়েছে। এদিকে বিএসইসির মার্কেট অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়েটরস বিভাগের নির্বাহী পরিচালক পদ থেকে মাহবুবুল আলম পদত্যাগ করার পর এ বিভাগের অনেক কাজই থমকে আছে। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর অফিস করছেন না তিনি। আবার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে কিনা, জানে না বিএসইসির প্রশাসন বিভাগ। মাহবুবুল আলমের পদে কেউ না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বহু সংখ্যক ফাইল পড়ে আছে। কমিশনের সিদ্ধান্তের জন্য ফাইলগুলো সরাসরি সংশ্লিষ্ট কমিশানরের কাছে পাঠাবেন কিনা– সে সিদ্ধান্ত জানতে সাক্ষাৎ চেয়েও মেলেনি। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, গত ৫ মার্চের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর ৬ মার্চ কর্মবিরতি পালন করলেও পরের কর্মদিবস রোববার তারা কাজে যোগ দিয়েছেন। কমিশনের অভিভাবক হিসেবে বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা কোনো আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, প্রেষণে মন্ত্রণালয় থেকে কর্মকর্তা আনার বিষয়ে প্রশাসন বিভাগও কিছু জানে না। এর অর্থ কমিশন হয়তো বর্তমান কর্মকর্তাদের আস্থায় নিতে চাচ্ছে না। কিন্তু শেয়ারবাজার বিষয়টি ‘টেকনিক্যাল’ হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উচ্চপদে এনে কীভাবে কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলবে, তা বোধগম্য নয়। কর্মকর্তারা আরও জানান, গত ৯ মার্চ বাজারের সব অংশীজন এবং শেয়ারবাজারের অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দুই ঘণ্টার বৈঠক করেছেন চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা। গত ১৬ মার্চ কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে কর্মকর্তাদের দোষারোপ করেছেন। অথচ ১০ মার্চের সভায় সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে বৈঠক ডেকে পুলিশ প্রহরা নিয়ে মাত্র ৫ মিনিট চেয়ারম্যান কিছু কথা বলেছেন। কর্মকর্তাদের কিছু বলারই সুযোগ দেননি। ফলে কর্মপরিবেশ ভালো হওয়ার পরিবর্তে আরও খারাপ হয়েছে। সবার মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আশঙ্কার কারণ জানতে চাইলে কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, তারা শুনেছেন, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে করা মামলার আসামি সংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২৩ জন করার চেষ্টা করছেন বিএসইসি চেয়ারম্যান। এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল কাইউম সমকালকে জানান, এ বিষয়ে তাঁর কাছে কোনো তথ্য নেই। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামিউল কিছু জানতে পারেন। পরে ফোনে তদন্ত কর্মকর্তা সমকালকে জানান, গত ১৪ মার্চ বিএসইসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। কী কথা হয়েছে জানতে চাইলে এসআই শামিউল বলেন, যাতে মামলার তদন্ত সুষ্ঠু হয় এবং এজাহারভুক্ত আসামিদের বাইরে আর কারও সম্পৃক্ততা থাকলে তাদেরও যেন আসামি করা হয়। নতুন কাউকে আসামি করা হচ্ছে কিনা– এসআই শামিউল বলেন, ঘটনার দিন কর্মকর্তারা কমিশনের সব সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। ফলে রেকর্ড ঘটনার সময়ের বা আগে ও পরের কমিশন ভবনের অভ্যন্তরের ঘটনার কোনো রেকর্ড বা ফুটেজ মেলেনি। ফলে আর কারও কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কমিশনের বক্তব্য সার্বিক বিষয়ে জানতে কমিশনের চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে ফোন করা হলে তিনি গত রোববার আরও কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে এ প্রতিবেদককে তাঁর অফিসে আমন্ত্রণ জানান। প্রায় দুই ঘণ্টা কমিশনের চেয়ারম্যান ও তিন কমিশনার মোহসিন চৌধুরী, আলী আকবর ও ফারজানা লালারুখ ৫ মার্চ তাদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের চরম অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং সেনাবাহিনী এসে উদ্ধার করার আগের চার ঘণ্টায় লাইট ও এসি বন্ধ করা ২০০ বর্গফুটেরও কম কমিশন সভাকক্ষে কীভাবে দেড়শজন কর্মকর্তা ‘দমবন্ধ’ পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন, তার বর্ণনা দেন। বিএসইসির চেয়ারম্যান জানান, গত ৫ মার্চ বোর্ডরুমে কমিশনকে টানা চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ করার ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল। নিজেদের অপরাধের প্রমাণ লুকাতে তারা আগেই সিসিটিভি বন্ধ করেছিল। এমনকি অফিসের বিদ্যুৎ, প্রতিটি ফ্লোরের দরজা এবং নানা প্রয়োজনে আসা শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টদের বের করে দিয়ে মূল ফটকও বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি জানান, পদোন্নতি কেন হচ্ছে না– এ নিয়ে অনেকের ক্ষোভ আছে। যদিও এর জন্য কমিশন দায়ী নয়। তাদেরই একজন হাইকোর্টে রিট করায় পদোন্নতি বিষয়ে স্থিতাবস্থার আদেশ আছে। কমিশনার মোহসীন চৌধুরী জানান, কর্মকর্তাদের অনেকে কমিশনের সিদ্ধান্তের নোট পরিবর্তন করে ফেলতেন। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, কয়েকজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ গৃহনির্মাণ ঋণ নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড় জমি কিনছেন। তারা এগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে চেয়েছেন। বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে চাওয়া কারও কারও পছন্দ নাও হতে পারে, যে কারণে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। কমিশনার আলী আকবর বলেন, শেয়ারবাজার অনিয়ম উদ্ঘাটনে বিশেষ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যাদের বিষয়ে অভিযোগ মিলেছে, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। এতে ক্ষোভের কী আছে? কেউ কী আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তা ঘটনার নানারূপ বর্ণনা করলেও এর জেরে কমিশনের কাজে যে এক প্রকার স্থবিরতা চলছে, সেদিকে কেউ আলোকপাত করেননি। এর সার্বিক নেতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়ার শঙ্কা আছে– সে বিষয়টিও যে তারা খুব আমলে নিচ্ছেন, তা পরিষ্কার হয়নি। এ বিষয়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের কোনো মন্তব্য মেলেনি। এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস
অন্যদিকে, ৫ মার্চ অবরুদ্ধ করার ঘটনায় ১৬ জনের নাম উল্লেখসহ আরও অনেক কর্মকর্তা জড়িত থাকতে পারেন উল্লেখ করে মামলা দায়ের এবং কর্মকর্তাদের পুরো দায় দিয়ে মন্ত্রণালয়ে কমিশনের চিঠি পাঠানোতে অনেকে উদ্বিগ্ন। আবার নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর আরও কয়েকজনের বিষয়ে একই রকম পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে তাদের। এরই মধ্যে প্রেষণে কর্মকর্তা চেয়ে অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর পর চাপা ক্ষোভ আরও বেড়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, তারা স্বাভাবিক কাজে ফিরতে চাইছেন; কিন্তু কমিশনের দিক থেকে আন্তরিকতা দেখছেন না। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন কর্মকর্তারা। যদিও মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে এখনও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। এদিকে, গত সোমবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে বিএসইসিকে আরও শক্তিশালী করা ও পুঁজিবাজার উন্নয়নে চার সদস্যের একটি কমিটি করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এ কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. এম সাদিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, কমিটি দীর্ঘমেয়াদি বিষয় নিয়ে কাজ করবে। তবে এখন যে অবস্থা চলছে, তা অস্বাভাবিক। এর দ্রুত অবসান হওয়া দরকার। সার্বিক বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী সমকালকে বলেন, এ অবস্থায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা চলতে পারে না। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে দায়িত্ব বেশি কমিশনের, কারণ তারাই অভিভাবক। প্রেষণে সরকারি কর্মকর্তা এনে বিএসইসি চলবে না– মত দিয়ে সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, বিএসইসি স্বতন্ত্র ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এখানকার ‘টেকনিক্যাল’ কাজ সরকারের কর্মকর্তাদের দিয়ে হবে না। এটি করাও ঠিক হবে না। বিএসইসির পরিস্থিতি গত কয়েক দিন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিএসইসি কার্যালয়ে নানা পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রুটিন কিছু কাজ চললেও কমিশনের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হচ্ছে। চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের সঙ্গে অধস্তন কর্মকর্তাদের অনাস্থা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ আগের মতোই। কর্মকর্তারা ভয়ে আছেন, অবরুদ্ধ করার ঘটনার জেরে কখন কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয় কমিশন। এ অবস্থার মধ্যেই বিএসইসির পক্ষ থেকে প্রেষণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি দিয়েছে কমিশন। চিঠির বিষয় বিএসইসির প্রশাসন বিভাগ জানে না। এর আগে ৫ মার্চের ঘটনায় কর্মকর্তাদের দায়ী করে বিস্তারিত জানিয়ে আরও একটি চিঠি কমিশন পাঠিয়েছিল। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক সমকালকে জানান, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিএসইসির চিঠিটি পাঠানো হয়েছে। এদিকে বিএসইসির মার্কেট অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়েটরস বিভাগের নির্বাহী পরিচালক পদ থেকে মাহবুবুল আলম পদত্যাগ করার পর এ বিভাগের অনেক কাজই থমকে আছে। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর অফিস করছেন না তিনি। আবার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে কিনা, জানে না বিএসইসির প্রশাসন বিভাগ। মাহবুবুল আলমের পদে কেউ না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বহু সংখ্যক ফাইল পড়ে আছে। কমিশনের সিদ্ধান্তের জন্য ফাইলগুলো সরাসরি সংশ্লিষ্ট কমিশানরের কাছে পাঠাবেন কিনা– সে সিদ্ধান্ত জানতে সাক্ষাৎ চেয়েও মেলেনি। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, গত ৫ মার্চের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর ৬ মার্চ কর্মবিরতি পালন করলেও পরের কর্মদিবস রোববার তারা কাজে যোগ দিয়েছেন। কমিশনের অভিভাবক হিসেবে বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা কোনো আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, প্রেষণে মন্ত্রণালয় থেকে কর্মকর্তা আনার বিষয়ে প্রশাসন বিভাগও কিছু জানে না। এর অর্থ কমিশন হয়তো বর্তমান কর্মকর্তাদের আস্থায় নিতে চাচ্ছে না। কিন্তু শেয়ারবাজার বিষয়টি ‘টেকনিক্যাল’ হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উচ্চপদে এনে কীভাবে কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলবে, তা বোধগম্য নয়। কর্মকর্তারা আরও জানান, গত ৯ মার্চ বাজারের সব অংশীজন এবং শেয়ারবাজারের অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দুই ঘণ্টার বৈঠক করেছেন চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা। গত ১৬ মার্চ কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে কর্মকর্তাদের দোষারোপ করেছেন। অথচ ১০ মার্চের সভায় সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে বৈঠক ডেকে পুলিশ প্রহরা নিয়ে মাত্র ৫ মিনিট চেয়ারম্যান কিছু কথা বলেছেন। কর্মকর্তাদের কিছু বলারই সুযোগ দেননি। ফলে কর্মপরিবেশ ভালো হওয়ার পরিবর্তে আরও খারাপ হয়েছে। সবার মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আশঙ্কার কারণ জানতে চাইলে কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, তারা শুনেছেন, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে করা মামলার আসামি সংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ২৩ জন করার চেষ্টা করছেন বিএসইসি চেয়ারম্যান। এ বিষয়ে জানতে ফোন করা হলে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল কাইউম সমকালকে জানান, এ বিষয়ে তাঁর কাছে কোনো তথ্য নেই। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শামিউল কিছু জানতে পারেন। পরে ফোনে তদন্ত কর্মকর্তা সমকালকে জানান, গত ১৪ মার্চ বিএসইসির চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাঁর ফোনে কথা হয়েছে। কী কথা হয়েছে জানতে চাইলে এসআই শামিউল বলেন, যাতে মামলার তদন্ত সুষ্ঠু হয় এবং এজাহারভুক্ত আসামিদের বাইরে আর কারও সম্পৃক্ততা থাকলে তাদেরও যেন আসামি করা হয়। নতুন কাউকে আসামি করা হচ্ছে কিনা– এসআই শামিউল বলেন, ঘটনার দিন কর্মকর্তারা কমিশনের সব সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দেন। ফলে রেকর্ড ঘটনার সময়ের বা আগে ও পরের কমিশন ভবনের অভ্যন্তরের ঘটনার কোনো রেকর্ড বা ফুটেজ মেলেনি। ফলে আর কারও কোনো সম্পৃক্ততা ছিল কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কমিশনের বক্তব্য সার্বিক বিষয়ে জানতে কমিশনের চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে ফোন করা হলে তিনি গত রোববার আরও কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে এ প্রতিবেদককে তাঁর অফিসে আমন্ত্রণ জানান। প্রায় দুই ঘণ্টা কমিশনের চেয়ারম্যান ও তিন কমিশনার মোহসিন চৌধুরী, আলী আকবর ও ফারজানা লালারুখ ৫ মার্চ তাদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের চরম অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং সেনাবাহিনী এসে উদ্ধার করার আগের চার ঘণ্টায় লাইট ও এসি বন্ধ করা ২০০ বর্গফুটেরও কম কমিশন সভাকক্ষে কীভাবে দেড়শজন কর্মকর্তা ‘দমবন্ধ’ পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন, তার বর্ণনা দেন। বিএসইসির চেয়ারম্যান জানান, গত ৫ মার্চ বোর্ডরুমে কমিশনকে টানা চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ করার ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল। নিজেদের অপরাধের প্রমাণ লুকাতে তারা আগেই সিসিটিভি বন্ধ করেছিল। এমনকি অফিসের বিদ্যুৎ, প্রতিটি ফ্লোরের দরজা এবং নানা প্রয়োজনে আসা শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টদের বের করে দিয়ে মূল ফটকও বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি জানান, পদোন্নতি কেন হচ্ছে না– এ নিয়ে অনেকের ক্ষোভ আছে। যদিও এর জন্য কমিশন দায়ী নয়। তাদেরই একজন হাইকোর্টে রিট করায় পদোন্নতি বিষয়ে স্থিতাবস্থার আদেশ আছে। কমিশনার মোহসীন চৌধুরী জানান, কর্মকর্তাদের অনেকে কমিশনের সিদ্ধান্তের নোট পরিবর্তন করে ফেলতেন। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, কয়েকজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ গৃহনির্মাণ ঋণ নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড় জমি কিনছেন। তারা এগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে চেয়েছেন। বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে চাওয়া কারও কারও পছন্দ নাও হতে পারে, যে কারণে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। কমিশনার আলী আকবর বলেন, শেয়ারবাজার অনিয়ম উদ্ঘাটনে বিশেষ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যাদের বিষয়ে অভিযোগ মিলেছে, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো কোনো কর্মকর্তাকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। এতে ক্ষোভের কী আছে? কেউ কী আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তা ঘটনার নানারূপ বর্ণনা করলেও এর জেরে কমিশনের কাজে যে এক প্রকার স্থবিরতা চলছে, সেদিকে কেউ আলোকপাত করেননি। এর সার্বিক নেতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়ার শঙ্কা আছে– সে বিষয়টিও যে তারা খুব আমলে নিচ্ছেন, তা পরিষ্কার হয়নি। এ বিষয়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের কোনো মন্তব্য মেলেনি। এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস