ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম 'ফেসবুক'-এ চলমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ মিলেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) সহায়তায় ফেসবুকের পাঁচটি গ্রুপ ও ১৪টি অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করেছেন। এই গ্রুপ তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে সমাপনীর বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্ন আপলোড করেছে বলে তদন্তকালে তারা দেখতে পেয়েছেন। তদন্তে দেখা গেছে, এসব অ্যাকাউন্টধারী বেশিরভাগই তাদের কনটেন্ট আপলোড করেছেন ময়মনসিংহ ও বগুড়া- এ দুটি জেলা থেকে। তাদের আপলোড করা কথিত প্রশ্নের ৬০ থেকে ৯০ শতাংশই পরীক্ষার মূল প্রশ্নপত্রে কমন পড়েছে। এখন র্যাবের গোয়েন্দা শাখার মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। চিহ্নিত ১৪টি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে রাজধানীর মিরপুর থানায় মঙ্গলবার মামলা দায়ের করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. পারভেজ বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন। সূত্র জানায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই এই তদন্ত শুরু হয়। চিহ্নিত হওয়া সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টের সবক'টিরই নাম ও ছবি ভুয়া বলে প্রাথমিকভাবে কর্মকর্তাদের কাছে মনে হয়েছে। মিজানুর রহমান ও সৈয়দ মিজানুর রহমান নামের কথিত প্রশ্ন আপলোড করা দুটি অ্যাকাউন্টে প্রোফাইল পিকচার হিসেবে একই ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ময়মনসিংহ এলাকা থেকে রেজাউল করিম নামের দুটি পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রশ্ন আপলোড করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কারণ, ময়মনসিংহেই অবস্থিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশনের দায়িত্ব ছিল এ প্রতিষ্ঠানটির ওপর। গত বছর প্রাথমিক সমাপনীর প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গেও নেপের নাম উঠেছিল। প্রশ্নপত্র মডারেশনের দায়িত্বে থাকা একজন শিক্ষকের ময়মনসিংহ শহরে থাকা কোচিং সেন্টার থেকে প্রথমে এ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল বলে গতবার সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব এস এম আশরাফুল ইসলাম এ কমিটির প্রধান ছিলেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে বরাবরই সমাপনীর প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এর আগে জানিয়েছেন, সমাপনীর কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। ফাঁস হলে তিনি এর দায় নেবেন। তবে মন্ত্রী অস্বীকার করলেও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিটিআরসি তদন্ত চালিয়ে ফেসবুকের এসব অ্যাকাউন্ট ও গ্রুপ চিহ্নিত করেছে। এদিকে, ফেসবুকের নানা গ্রুপ থেকে পাওয়া প্রশ্নগুলো পরদিনের পরীক্ষায় ৬০ থেকে ৯০ শতাংশই কমন পড়ায় শিক্ষার্থী ও সাধারণ অভিভাবকরা প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগকে 'নিছক গুজব' বলে মানতে পারছেন না। প্রশ্ন ফাঁসের সত্যতা নিয়ে তাদের মনে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস জন্মেছে। এ নিয়ে অভিভাবকরা চরম ক্ষুব্ধও। এ অবস্থায় অভিভাবকদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন ফাঁসের জোরালো অভিযোগের মধ্য দিয়ে আজ রোববার শেষ হয়ে যাচ্ছে ২০১৪ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। ৩০ লাখ পরীক্ষার্থী নিয়ে ২৩ নভেম্বর শুরু হয় এ পরীক্ষা। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পাঁচটি পরীক্ষার প্রতিটিরই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে মন্ত্রণালয় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। সরকারের সব রকম সতর্কতা সত্ত্বেও চলতি বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ফেসবুক ঘেঁটে এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি গ্রুপ থেকে বেশি করে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে https://www.facebook.com/pages/PSC-JSC-SSC-HSC-All-Exam-Question-100Common-By-ReZza/373229762855457 PSC • JSC • SSC • HSC All Exam Question 100%Common By ReZza এই গ্রুপটিতে শতভাগ প্রশ্ন কমন পড়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে গত কয়েক দিনে। এমনকি আজ রোববার অনুষ্ঠিতব্য গণিত পরীক্ষার কথিত প্রশ্নপত্রও ছড়ানো হয়েছে। এ ছাড়াও https://www.facebook.com/groups/617957428245157/Bangladesh PSC JSC SSC HSC Exam Informations &Suggestions এবং https://www.facebook.com/BPJSH এবং Bangladesh PSC JSC SSC HSC Exam Informations &Suggestions এবং Bangladesh PSC JSC SSC HSC Exam Informations &Suggestions ইত্যাদি অ্যাড্রেসেও প্রাথমিক সমাপনীর প্রশ্নপত্র ছড়ানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করা হলেও ভেতরে ভেতরে দোষীদের খুঁজে বের করার সরকারি প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। গোপনে বিটিআরসির মাধ্যমে আবারও ফেসবুকে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস নয়, ফেসবুকে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হয়েছে। মামলা দায়েরের পর এখন পুলিশ, র্যাব এবং বিটিআরসির মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে খুঁজে বের করা চেষ্টা করা হচ্ছে কারা গুজব ছড়িয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি সংক্রান্ত এক সভায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে প্রয়োজনে পরীক্ষার সময়ে 'ফেসবুক' ও 'মোবাইল ফোন' বন্ধ রাখা যায় কি-না সেজন্য আইন খতিয়ে দেখতেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে। ফেসবুকে প্রশ্নফাঁস নিয়ে এত আলোচনার মাঝে নিজের অভিমত জানিয়ে বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার সমকালকে বলেন, ফেসবুকে খুঁজে বেড়ালেও প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরা যাবে না। কারণ, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মডারেশন, বিতরণ বা সংরক্ষণের সঙ্গে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কোনো সম্পর্ক নেই। শিক্ষা ও পরীক্ষার কাজে যারা জড়িত, তাদেরই কারও মধ্য থেকে প্রশ্ন ফাঁস করা হয়। এরপর তা সামাজিক মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকে উঠে আসতে পারে। সেখানে নানা আলোচনা-সমালোচনা হতেই পারে। তিনি বলেন, সরকারের বন্দুকটা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের দিকে তাক না করে পরীক্ষা এবং প্রশ্নের দায়িত্বে যারা থাকেন তাদের দিকে করাই সমীচীন। নইলে প্রকৃত দোষীরা আড়ালেই থেকে যাবে।