মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের অধীনে দশকের পর দশক ধরে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গারা। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে তাদের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করেছে দেশটির জান্তা সরকার। ফলে রোহিঙ্গারা বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি। নিজ দেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর বর্তমানে বাংলাদেশের জনাকীর্ণ শিবিরে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। এদের অধিকাংশই ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সম্ভাব্য গণহত্যার হাত থেকে বাঁচতে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন।
সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘের সহযোগী সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারের বরাদ্দ অর্ধেকের বেশি কমানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশকে। সংস্থাটি বলেছে, জরুরি নতুন তহবিল পাওয়া না গেলে রোহিঙ্গাদের জন্য মাসিক খাবারের বরাদ্দ আগামী এপ্রিল থেকে সাড়ে ১২ ডলার থেকে ছয় ডলারে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে তারা।
কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা যখন ভবিষ্যতে খাদ্য সংকটের চিন্তায় পড়েছেন, তখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সাথে নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফরে আসছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস।
এমন পরিস্থিতিতে এই সফর রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কতখানি কার্যকরি হবে সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
শরণার্থী ও ত্রাণ প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এর মাধ্যমে রোহিঙ্গারা কনফিডেন্স ফিরে পাবে। তারা তাদের দেশে যাওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে। এবং তারা মনে করবে বিশ্ব সম্প্রদায় তাদের পাশে আছে।’
এদিকে আগামী মাস থেকে রেশনের খরচ অর্ধেকে নেমে আসার খবরে অনেককেই নিজের ভাগের রেশনের সবটুকু কিনতে দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথা হয় আজিজুল হকের সাথে। তিনি ক্যাম্প থেকে রেশনের খাবার নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন।
আজিজুল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আগামী মাস থেকে শুনছি রেশন কমিয়ে দিবে। এজন্য ডিম, ডাল, চিনি এগুলো নিয়ে রেখেছি। কী করবো, কমিয়ে দিলে তো আর কুলাবে না, তখন অনেক কষ্ট হবে।’
বিবিসি বাংলার সাথে আলাপকালে এই রেশন কমানোর খবরে নাখোশ অনেকে নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরার কথাও বলছিলেন।
এক লাখ রোহিঙ্গার সাথে ইফতার
জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস চারদিনের সফরের দ্বিতীয় দিন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করবেন। বাংলাদেশে এটি তার দ্বিতীয় সফর। এর আগে ২০১৮ সালে তিনি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।
গুতেরেসের এবারের সফরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু। শুক্রবার সকালে প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ঢাকা থেকে কক্সবাজারে আসার পর বেলা দেড়টায় উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনে যাবেন। তারা সেখানে ক্যাম্প-১৮-তে লার্নিং সেন্টারে যাবেন এবং শরণার্থী ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের সাথে কথা বলবেন।
এরপর মহাসচিব রোহিঙ্গা কালচারাল মেমোরি সেন্টার পরিদর্শন ও মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করবেন। সন্ধ্যায় ক্যাম্প-২০ এক্সটেনশন হেলিপ্যাড এলাকায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের জন্য প্রধান উপদেষ্টা আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।
শনিবার ক্যাম্প এলাকা পরিদর্শনে এসে শরণার্থী ও ত্রাণ প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই ইফতারটি এক ধরনের সলিডারিটি প্রোগ্রাম। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব প্রত্যেক বছর একটি মুসলিম দেশে গিয়ে সলিডারিটি ইফতার করেন। এবার সৌভাগ্যক্রমে এটি বাংলাদেশে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা। তারা তাদের রাষ্ট্র ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে নির্যাতিত হলেও রোহিঙ্গারা একা নয়, বিশ্ব সম্প্রদায় তাদের পাশে রয়েছে। এই ইফতারের মাধ্যমে এটাই বোঝানো হচ্ছে।’
‘রামাদান সলিডারিটি’ ইফতার কর্মসূচি ঘিরে এরই মধ্যে প্রায় সব প্রস্তুতি শেষ করার কথা জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও শরণার্থী কমিশনার।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতির কী হবে?
রোহিঙ্গাদের জন্য এপ্রিল থেকে খাদ্য সহায়তার ঘোষণা এর আগেই দিয়েছে জাতিসঙ্ঘের খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব এমন এক সময়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করতে আসছেন যখন রোহিঙ্গাদের মাসিক খাদ্য সহায়তা কমিয়ে আনা হচ্ছে।
ফলে এপ্রিল মাস থেকে তারা ৫২ শতাংশ কম খাবার কিনতে পারবে। এ কারণে অনেকেই আগেভাগে বাড়তি খাবার কিনে রাখছেন।
তেমনই একজন আজিজুল হক। তিনি জানান, সামনের মাসে তারা যে রেশন পাবে সেটি দিয়ে তাদের সংসার চলবে না। সে কারণে তিনি এ মাসে আগেভাগে কিছু খাবার কিনে রেখেছেন।
মূলত নিবন্ধিত রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে একটি কার্ড দেয়া হয়। এই কার্ড দিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে থাকা কিছু নির্দিষ্ট সরবরাহকারীর কাছ থেকে প্রতিমাসে জনপ্রতি সাড়ে ১২ ডলারের সমপরিমাণ বাজার করতে পারে।
বৃহস্পতিবার উখিয়ার চার নম্বর ক্যাম্প থেকে বাজার নিয়ে ফিরছিলেন হামিদা বেগম। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখন যে রেশন দেয় এই রেশনেই সংসার চলে না। এরপর যদি আরো কমায় আমাদের তো বাঁচার উপায় থাকবে না।’
অনেকের সাথেই কথা বলে যতটুকু বোঝা গেছে আগামী মাস থেকে খাদ্য সহায়তা কমার ঘোষণায় এ মাস থেকেই অনেকে খাবার সংগ্রহ করে রাখছে যাতে চরম সংকটে পড়তে না হয়। এমন অবস্থায় উখিয়া টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোতে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন দাতা দেশ বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে আসছে। এটি খুব সহজ কাজ নয়- ১২ লাখ মানুষকে শুধুমাত্র ত্রাণের ওপর দিয়ে চালিয়ে নেয়া।’
তিনি বলেন, ‘তারপরও আমাদের বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্র রয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র গত আট বছর ধরে আমাদেরকে সহযোগিতা করে আসছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন একটা ফান্ড ফ্রিজিংয়ের অর্ডার এসেছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে। আমরা আশা করি সেটি প্রত্যাহার করা হবে। ডব্লিউএফপি আমাদেরকে যে চিঠিটি দিয়েছে, তারা যদি ডোনারদের সাথে ভালো যোগাযোগ করতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি সেটি প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে হয়তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
আমাদের বার্মা ফেরত পাঠাও
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের সফর ঘিরে যখন পুরো ক্যাম্প এলাকায় স্থানীয় প্রশাসনের ব্যস্ততা চলছিলো তখন সেখানে রোহিঙ্গাদের এ নিয়ে খুব একটা উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি। তোড়জোড় যা ছিল তার বেশিভাগই স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে।
বিবিসি বাংলা বৃহস্পতিবার ক্যাম্প এলাকায় শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেছে। তাদের অনেকেই দাতা সংস্থাগুলোর অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তে নাখোশ।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের কথা বলা হলেও তখন অনেকেই কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরেই থাকার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু খাদ্য সহায়তা কমিয়ে আনার এই ঘোষণার পর থেকে ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মনোভাব অনেকটাই বদলেছে।
তাই জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টার সফরের আগের দিনই তাদের অনেকেই দাবি তোলেন, খাদ্য সহায়তা না বাড়িয়ে যেন তাদের দেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়।
পঞ্চাশোর্ধ মোহাম্মদ হোসেন বেশ ক্ষোভের সুরেই বলেন, ‘আমরা অসহায় হয়ে এখানে প্রাণ বাঁচাতে এসেছি। আমাদের খাবার দরকার নাই। এটা নিয়ে কিছু ভাবছি না। আমরা বার্মায় (মিয়ানমার) কিভাবে ফেরত যাবো সেটা জানা দরকার।’
প্রায় একই রকম ভাষ্য হামিদা বেগমেরও। তিনি বলেন, ‘দাবি-দাওয়া কিছু নাই। আমাদের দেশে আমরা ফিরে যেতে পারলেই খুশি। দেশে ঠিকভাবে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করলে ভালো লাগবে। আমাদের দ্রুত বার্মা (মিয়ানমার) পাঠান।’
বেশ আক্ষেপ নিয়েই বলছিলেন তিনি, ‘এ রকম করে কি সারাজীবন মানুষ চলতে পারে?’
এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কী কী করা হচ্ছে কিংবা কবে নাগাদ তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব- এমন প্রশ্নের জবাবে শরণার্থী ও ত্রাণ প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, প্রত্যাবাসনের বিষয়টি মিয়ানমারের ও বাংলাদেশের বিষয়, বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিষয়। এই বিষয়গুলো দুই দেশকে মিলেই ঠিক করতে হবে।
সূত্র : বিবিসি
এলএবাংলাটাইমস/আইটিএলএস